IQNA

"জাকা": গাজা যুদ্ধ নিয়ে ইসরায়েলের মিথ্যা প্রচারের কারখানা

14:46 - August 25, 2025
সংবাদ: 3477945
ইকনা- ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালের পর, “জাকা” নামের একটি সংস্থা ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধ নিয়ে লজ্জাজনক প্রচারণা চালায়। পশ্চিমা গণমাধ্যমে এগুলো ব্যাপকভাবে পুনঃপ্রকাশিত হয়।
ইকনা সংবাদ সংস্থা ইসলাম ওয়েব-এর বরাতে জানিয়েছে, “জাকা” একটি ইসরায়েলি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এর সদস্যরা অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় নিহতদের মরদেহ খুঁজে বের করা ও সংগ্রহের দায়িত্বে থাকে। এটি ইসরায়েলে একটি বেসরকারি সংস্থা হিসেবে পরিচিত। বলা হয়, এর সদস্যরা অনুসন্ধান ও দুর্ঘটনা পুনর্গঠন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।
এই বর্ণনাগুলো “জাকা”কে এক ধরনের আইনি বৈধতা দিয়েছে এবং এর সদস্যরা ৭ অক্টোবরের ঘটনা ও গাজা যুদ্ধ নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলার আদর্শ সুযোগ পেয়েছে। তারা নোভা উৎসব ও বিভিন্ন কিবুতজ থেকে মরদেহ সংগ্রহ করে সাংবাদিকদের কাছে সেসবের গল্প তুলে ধরেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোও তাদের বর্ণনার উপর নির্ভর করেছে এবং তারা CNN, Fox News, BBC, নিউইয়র্ক টাইমসসহ বহু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু সমস্যা হলো—তাদের অধিকাংশ বর্ণনাই ভয়াবহ মিথ্যা কাহিনি, যেগুলোর কোনো বাস্তবতা নেই। তবুও এগুলো কোনো প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নেওয়া হয়েছে এবং সেসব গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে যেগুলো মূলত হামাস ও সমগ্র ফিলিস্তিনি জাতিকে কলঙ্কিত করার উদ্দেশ্যে কাজ করে। এই প্রচারণা ছিল ইসরায়েলের অযৌক্তিক প্রতিক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক আদালতে ন্যায্যতা দেওয়ার প্রথম ধাপ—যে আদালত ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে “গণহত্যা” হিসেবে ঘোষণা করেছে।
গণমাধ্যমকে কখনো বলা হয়নি যে “জাকা”র স্বেচ্ছাসেবীরা নিরপেক্ষ নন। বরং তারা ইসরায়েলি সেনা ও উদ্ধার বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ে কাজ করে। তারা প্রচলিত মানবিক মানদণ্ড মানে না এবং কোনো চিকিৎসা বা ফরেনসিক বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়।
জাকা’র এক মুখপাত্র বলেন: “আমাদের বর্ণনা ঠিক একজন আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী ডাক্তার বা মানবিক সাক্ষীর সাক্ষ্যের মতোই বিশ্বাসযোগ্য।”
কিন্তু পরে প্রকাশিত হয়—“জাকা” যে কাহিনিগুলো উপস্থাপন করেছিল, তার অধিকাংশই গড়ে তোলা গল্প। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীন গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিকরা এসব বর্ণনা খণ্ডন করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, “শিশুদের মাথা কেটে ফেলা”র গল্প সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং পশ্চিমা পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়। অথচ “মিন্ট প্রেস নিউজ” জানায়, ২০টি শিশুর কাটা মাথার মরদেহের গল্প ইসরায়েলি সেনারা নিজেরাই অস্বীকার করার পরও সংবাদমাধ্যমে বারবার প্রচারিত হয়েছে।
ইসরায়েলের মিথ্যার কারখানা “জাকা”
ইসরায়েলি পত্রিকা হা’আরেতজ “জাকা”-র বানানো বহু ভৌতিক গল্প প্রকাশ করেছে। সেখানে শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল—“শিশুদের পোড়া দেহের স্তূপ” এবং “গর্ভবতী নারীর পেট ছিঁড়ে ভ্রূণকে ছুরিকাঘাত”!
«زاکا» سازمان دروغ‌ پراکنی اسرائیل درباره جنگ غزه
 
গর্ভের শিশুকে ছুরিকাঘাতের গল্পটি রটিয়েছিল “জাকা”র দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রধান ইউসি লানদাও। এটি পরে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমেও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। হা’আরেতজ পরবর্তীতে এর দায় সরাসরি লানদাওয়ের উপর চাপায়।
লানদাও ক্যামেরার সামনে এসে আবেগপূর্ণ ভাষায়, কৌশলী ভঙ্গিতে এবং কান্নার সুরে এসব কাহিনি বলত। এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে তাকে দেখা যায় চোখের জল ফেলতে ফেলতে গর্ভবতী নারী ও তার ভ্রূণের গল্প বলতে।
কিন্তু যখন হা’আরেতজ ওই কিবুতজের বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকার নেয়, তারা বলেছে—এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, এমনকি এলাকায় কোনো গর্ভবতী নারীও ছিল না। পরে হা’আরেতজ নিশ্চিত করে, এ গল্প পুরোপুরি মিথ্যা।
পরবর্তীতে লানদাও নিজেই স্বীকার করে যে এসব গল্প বানানো। ভিডিওতে তিনি বলেন: “আমরা যখন কোনো ঘরে প্রবেশ করি, আমাদের কল্পনা ব্যবহার করি। মরদেহগুলো আমাদের কাছে যা ঘটেছে তার গল্প বলে।”
«زاکا» سازمان دروغ‌ پراکنی اسرائیل درباره جنگ غزه
 
এমন স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও, লানদাও ও তার মতো আরও অনেকে এখনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
২০২৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর, নিউইয়র্ক টাইমস তার নাম প্রকাশ করে “৭ অক্টোবর হামাসের যৌন সহিংসতা” বিষয়ে এক তদন্ত প্রতিবেদনের উৎস হিসেবে। যদিও পত্রিকাটি স্বীকার করেছে, এর কোনো আইনি প্রমাণ বা দৃশ্যমান দলিল নেই। লানদাও দাবি করেছিল, সে ছবি তোলে নি কারণ তাকে অনুমতি দেওয়া হয়নি।
কিন্তু এটিও মিথ্যা, কারণ অন্য কয়েকজন “জাকা” সদস্য সাংবাদিকদের জানিয়েছে যে তারা এসব ঘটনার ছবি তুলেছে। টাইমস অব ইসরায়েল সিমশা গ্রিনম্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে—তাদের ছবি ও প্রমাণ সরাসরি সরকারি কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে। যদিও টাইমস অব ইসরায়েল নিজে সেসব ছবি দেখেনি।
২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বিনিয়ামিন নেতানিয়াহু “জাকা”র সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করেন। কারণ, এই সংগঠন ইসরায়েলের যুদ্ধকে বৈধতা দিতে ও দীর্ঘস্থায়ী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
মিথ্যা বর্ণনা দিয়ে গণহত্যার আড়াল
“জাকা”-র গল্পগুলো এখনো ছড়ানো হচ্ছে এবং সংবাদমাধ্যম সেগুলো প্রকাশ করছে। এমনকি এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের গণহত্যার অভিযোগ প্রতিরক্ষার জন্য এসব গল্প ব্যবহার করেছেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও শিশুদের মাথা কেটে ফেলার মিথ্যা কাহিনি পুনরাবৃত্তি করেছেন।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা যখন আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা দায়ের করে, তখন হামাসবিরোধী অপপ্রচার আরও বেড়ে যায়। এর ফলে গাজার গণহত্যা আড়াল করার কাজ সহজ হয়।
কিন্তু পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর যৌন সহিংসতার রিপোর্ট কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে। একজন লেখক এটিকে “খারাপ সাংবাদিকতা” বলে আখ্যায়িত করেছেন। এমনকি প্রশ্ন তুলেছেন—“নিউইয়র্ক টাইমস কি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে?”
পরে জানা যায়, প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক আনাত শোয়ার্তজ আসলে একজন প্রাক্তন ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা, যার সাংবাদিকতায় তেমন অভিজ্ঞতা নেই। তিনি এমনকি সামাজিক মাধ্যমে এক পোস্টে লাইক দিয়েছিলেন, যেখানে গাজাকে “হত্যাযজ্ঞে পরিণত করার” আহ্বান জানানো হয়েছিল। এ তথ্য ফাঁস হওয়ার পর নিউইয়র্ক টাইমস-এর ভেতরে সমালোচনা শুরু হয় এবং কয়েকজন সম্পাদক পদত্যাগ করেন।
 
এখন প্রশ্ন হলো—নিউইয়র্ক টাইমস কি গাজার চলমান যুদ্ধে আরও সঠিক, বাস্তবসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিবেদন দিতে পারবে? তারা কি সত্যিই সেই গণহত্যাকে “গণহত্যা” বলবে, যেটি এখন পুরো বিশ্ব জানে ইসরায়েল করছে? 4300527
 
captcha