গাজার শিশুদের ক্ষুধা
আলী মারুফি আরানি, যিনি হলেন ইহুদিবাদ ও জায়নিবাদ গবেষক, এক নোটে যার শিরোনাম “গাজা, আমাদের মানবতার আয়না! মুসলমানদের ভেসে যাওয়া স্বপ্নের একমাত্র স্মারক”—তিনি বলেন: নেতানিয়াহু যে অশুভ পরিকল্পনা ব্যবহার করছেন, যাতে পশ্চিম তীরকে এই শাসকের ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেটি গাজায় যুদ্ধ ও গণহত্যা বন্ধের প্রচেষ্টার প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও মুক্তি নির্ভর করছে প্রতিরোধের উপর। যখন ইসরাইল এই দেশটি দখল করে রেখেছে, তখন একমাত্র পথ রয়ে যায়—যুদ্ধের মাধ্যমে সংগ্রাম। আজ যখন জায়নিস্টদের অপরাধ ও ফিলিস্তিনিদের লড়াই ইতিহাসে নথিবদ্ধ হয়ে গেছে, তখন মিত্র দেশগুলো আলোচনা করছে যে তারা কি এখনো এই দখলদার জায়নিস্ট শাসকের পাশে থাকবে, নাকি নয়।
মূল লেখা:
গাজা উপত্যকার দখল আরব দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সবচেয়ে সম্ভাব্য দৃশ্যপটে এই প্রক্রিয়া ভেঙে পড়বে না; যদিও এটি জনমতের সামনে সেই দেশগুলোকে চাপে ফেলবে যারা এখনো এই শাসকের সাথে আপসের পথে আছে। এই প্রেক্ষিতে সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ ইসরাইলের জন্য এক দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নয় যা তার অন্যান্য পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করবে। তেলআবিব এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে আরব দেশগুলো, যারা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের শর্তে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের কথা বলে, পরে পিছিয়ে যায় এবং যুদ্ধ বন্ধের মতো নিচুস্তরের শর্তে নেমে আসে—তারা সহজেই এমন শর্তেও রাজি হতে পারে যে, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের গাজায় সামান্য ভালো অবস্থার বিনিময়ে ইসরাইল গাজা দখল করুক। (১)
ইসরাইলের হামলা গাজার নিরস্ত্র ও নিরপরাধ মানুষদের উপর চলছে, যখন আরব মুসলিম দেশগুলো, মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং পূর্ব-পশ্চিমের তথাকথিত মানবাধিকার রক্ষাকারী শক্তিগুলো কেবল নিন্দা বিবৃতি ও নৈতিক উপদেশ দিয়েই সীমাবদ্ধ থেকেছে। এই ভয়াবহ অপরাধ থামানোর জন্য কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
ইসলামি দেশগুলোতেও গাজার চেয়ে মারাত্মক নীরবতা বিরাজ করছে। এখনো পর্যন্ত ইসরাইলি অপরাধ থামাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এটি দেখায় যে, ফিলিস্তিনিরা দ্বিগুণ নিপীড়নের শিকার এবং তারা ইসলামী দুনিয়া ও অবিশ্বাসীদের খোলা চোখের সামনে করুণভাবে কোরবানি হচ্ছে।
আমার বিশ্বাস, বিশ্বকে অবশ্যই ফিলিস্তিনের পক্ষে আরও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ইসরাইলের আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডকে নিন্দা করতে হবে। ফিলিস্তিনের বিষয়টিকে পৃথিবীর সকল ঈমানদার মানুষের সংহতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। আমাদের উচিত, ইসরাইলের নৃশংস কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আওয়াজ উচ্চকণ্ঠে তোলা।
প্রজ্ঞাবান নেতা (ইরানের সর্বোচ্চ নেতা) এই শাসকের পতন নিয়ে নিখুঁত ও বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ দিয়েছেন এবং বলেছেন যে এই পরাজয় আর পূরণযোগ্য নয়। এটি একটি বাস্তবতা, যা মাঠের পরিস্থিতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত ৭৫ বছরে প্রথমবারের মতো ইসরাইল সামরিক ও গোয়েন্দা উভয় ক্ষেত্রেই এমন ভয়াবহ পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছে।
নেতার বক্তব্য স্পষ্ট করে দেয় যে ভবিষ্যতে এই শাসকের জন্য জটিল পরিস্থিতি তৈরি হবে। যদিও আমেরিকা ও পশ্চিমারা গাজার জন্য এক বিপজ্জনক পরিকল্পনা করেছে, যা হলো গাজার মানুষদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ ও বহিষ্কার, অর্থাৎ গাজা শহর ধ্বংস করে সেটিকে ফিলিস্তিনের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা।
ইসরাইল বারবার বোমাবর্ষণ ও গণহত্যার মাধ্যমে গাজায় প্রবেশের সুযোগ তৈরি করতে চাচ্ছে। তারা গাজা দখল করতে চায়, যদিও এতে মানবিক ও লজিস্টিক খরচ বিপুল হবে।
গাজায় প্রবেশ মানে হবে এক তীব্র ও ঘনিষ্ঠ যুদ্ধ, যা তাদের পরাজয়ের কারণ হবে—যদিও এই দখলদার শাসকের হাতে ৬০০-রও বেশি আধুনিক যুদ্ধবিমান রয়েছে।
আজ দুর্ভাগ্যবশত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তে ‘জঙ্গলের আইন’ কার্যকর হচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলো মানবাধিকারকে কেবল নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এর উদাহরণ আমরা গত বছরও দেখেছি।
আমেরিকানরা এমন একটি পরিকল্পনা করছে যাতে গাজার মানুষদের সিনাই মরুভূমি বা ফিলিস্তিন দখলকৃত এলাকার পার্শ্ববর্তী দেশে উচ্ছেদ করা হয়। এই পরিকল্পনা নতুন মধ্যপ্রাচ্য গঠনের অংশ, যার রচয়িতা আমেরিকা ও ইসরাইল। তাদের লক্ষ্য হলো গাজাকে ফিলিস্তিনের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা, যদিও প্রতিরোধ শক্তি এ কাজের পথে বাধা হবে।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী যেভাবেই হোক হামাসকে পরাজিত করতে চায়, যাতে তারা গাজার কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে এবং ২২ লাখ মানুষকে ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী সীমিত এক অঞ্চলে বসবাসে বাধ্য করতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে ইসরাইলি সেনাবাহিনী ২০ বছর পর আবার গাজা দখল করবে এবং নিয়ন্ত্রণ নেবে। এমন পরিকল্পনা লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিককে উদ্বাস্তু করবে এবং তাদের বাধ্য করবে ভূমধ্যসাগরের তীরে এক সরু এলাকায় জীবনযাপন করতে।
বর্তমানে দুই হাজার মার্কিন সেনা দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবস্থান করছে এবং তারা ইসরাইলি সেনাদের সাথে গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, এমনকি স্থল আক্রমণের প্রস্তুতিও নিচ্ছে। আবারও মনে হচ্ছে, মার্কিন-ইসরাইলি পরিকল্পনা হলো গাজার মানুষদের সিনাই মরুভূমি ও প্রতিবেশী দেশে উচ্ছেদ করা। তাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য গাজাকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা।
ইসলামি দেশগুলোতেও এখনো গাজা হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে ভয়াবহ নীরবতা চলছে, এবং কোনো বাস্তব প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
তবে যা ইসরাইলি বোমাবর্ষণকে আরও বেদনাদায়ক করে তুলেছে তা হলো, এই ছোট্ট গাজা উপত্যকা বহু বছর ধরে অমানবিক অবরোধে রয়েছে এবং এখানকার মানুষ ভয়ঙ্কর মানবিক সংকটে দিন কাটাচ্ছে। সময় ফুরানোর আগে গাজাকে অন্য চোখে দেখতে হবে।
ইসরাইলের অশুভ পরিকল্পনার বহুমাত্রিক ও বিপজ্জনক লক্ষ্যসমূহ:
• গাজার সম্পূর্ণ দখল: গাজার ওপর স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যেকোনো ফিলিস্তিনি শাসন বা স্বশাসনের অবসান।
• হামাস ও প্রতিরোধ ধ্বংস: প্রতিরোধের মূল শক্তি হিসেবে হামাসকে সম্পূর্ণ নির্মূল।
• জনসংখ্যা ও ভূগোল পরিবর্তন (জোরপূর্বক উচ্ছেদ): জনগণকে সিনাই মরুভূমি বা ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী সরু অঞ্চলে ঠেলে দেওয়া। চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো গাজাকে ফিলিস্তিনের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা ও জাতিগত নিধন।
• অবকাঠামো ধ্বংস: ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল ইত্যাদি ধ্বংস করে জীবনযাপন অসম্ভব করা, যাতে মানুষ ফিরে আসতে না পারে।
• ইসরাইলের নিরাপত্তা সুরক্ষা (নিজস্ব দৃষ্টিতে): গাজা দখল করে প্রতিরোধ ধ্বংসের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষিণাঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা।
• আরব দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ: স্বল্পমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব থাকলেও, গাজার “সমস্যা সমাধান” করে দীর্ঘমেয়াদে পূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন।
সারসংক্ষেপে, এই পরিকল্পনার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো গাজার সম্পূর্ণ দখল, প্রতিরোধ ধ্বংস, জনসংখ্যাগত পরিবর্তন, এবং ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—যা এক নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক মানচিত্রে স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে।
চূড়ান্ত উপসংহার:
বিশ্ব আর শুধু দর্শক হয়ে থাকতে পারে না। এখন সময় এসেছে ফিলিস্তিনের পক্ষে বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার এবং এই আগ্রাসনকে নিন্দা করার। ফিলিস্তিনের বিষয়টিকে বিশ্বব্যাপী ঈমানদার ও স্বাধীনচেতা মানুষের সংহতির কেন্দ্রে আনতে হবে। আমাদের প্রতিবাদের আওয়াজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে উঁচু হতে হবে।
সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে আমাদের গাজাকে অন্য চোখে দেখতে হবে—কর্মের চোখে, সংহতির চোখে, নীরবতা ভাঙার চোখে। কারণ গাজা আজ জাগ্রত মানবতার হৃদস্পন্দন।
তথ্যসূত্র:
১. হাসান হানিজাদে, পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ; তেহরান প্রেস-এ সাক্ষাৎকার
4301759