IQNA

শরণার্থী সুরক্ষায় ইসলামের ভূমিকা

21:11 - August 27, 2025
সংবাদ: 3477961
ইকনা- মানবসমাজের ইতিহাসে শরণার্থীর সমস্যা নতুন নয়। যুদ্ধ, নিপীড়ন, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের কারণে মানুষ বারবার নিজভূমি ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র গিয়েছে। আর বর্তমানে তো আমরা এখন এমন এক বিশ্বে অবস্থান করছি যেখানে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোতামে আঙুল সেঁটে বসে আছেন ক্ষমতাধর মানুষগুলো। যেকোনো সময় আগুনের লেলিহান শিখার খাদ্যে পরিণত হতে পারে গোটা জগত।
আর লাখ লাখ মানুষ হতে পারেন শরণার্থী। বাধ্য হতে পারেন নিজের ভালোবাসার বাড়ি-ঘর ছেলে অন্যের আশ্রিত হতে। কিন্তু এই ভাগ্যাহত মানুষগুলোর সাথে কি সবাই উপযুক্ত আচরণটুকু করতে পারছি? হতে পারছি কি তাদের প্রতি সদয়? দিতে পারছি কি তাদের মাথায় একটু শান্তনার হাত?

 

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শরণার্থীর অধিকার আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা স্বীকৃত হলেও চৌদ্দ শ’ বছর আগে ইসলাম এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতি ঘোষণা করেছে। মদিনায় হিজরত, মুহাজির-আনসারের ভ্রাতৃত্ব, এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় ইসলামী শিক্ষাই মানবতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

 

 

আধুনিক সভ্যতায়  জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের এখন মোট জনসংখ্যার প্রতি ৭৭ জনের একজন শরণার্থী। এক দশক ধরে প্রতিবছর শরণার্থীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২০২১ সালের শেষে বিশ্বে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৯ কোটি ৯৩ লাখে। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর এই সংখ্যা এখন ১০ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে।

 

 

১৯৫১ সালের জেনেভা কনভেনশনের ঘোষণামতে একজন শরণার্থী হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি নির্যাতন, সংঘাত কিংবা সহিংসতার কারণে নিজ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা, রাজনৈতিক মতাদর্শ অথবা বিশেষ কোনো সামাজিক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হওয়ার কারণে শরণার্থীদের নিগৃহীত হওয়ার স্পষ্ট আশঙ্কা থাকে।

 

শরণার্থীদের সুরক্ষার জন্য একটি বিশেষ আইনি কাঠামো তৈরি করা হয়, যা ১৯৪৯ সালের জেনেভা সম্মেলন থেকে শুরু হয়েছিল।

পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭ সালে শরণার্থীদের ওপর আরো বেশি মনোযোগ দিয়ে দুটি অতিরিক্ত নীতি যুক্ত করা হয়। এরপর ১৯৫১ সালের জেনেভা সম্মেলনের পর ১৯৬৭ সালে তাতে নতুন নীতিমালা আনা হয়।

 

 

উল্লিখিত বিষয় ছাড়াও ১৯৪৮ সালে ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের (ইউডিএইচআর)  শরণার্থীদের জন্য আইনি সুরক্ষার একটি শক্তিশালী এবং বিস্তৃত কাঠামো রয়েছে। এই ঘোষণাপত্রের ১৪(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকেরই অত্যাচার থেকে অন্য দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করা এবং তা উপভোগ করার অধিকার রয়েছে।’

 

উপরোক্ত সব উদ্যোগই গত কয়েক দশকের মাত্র। তার বিপরীতে ইসলাম এই অধিকারবঞ্চিত মানুষগুলোর নিরাপত্তা বিধান করে দিয়েছে বহু শতাব্দী আগে থেকেই।

যেখানে মৃত্যুর অমানিশা, সেখানে ভোরের মিছিল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইসলাম। যেখানে পুঁজি ও প্রতিপত্তির শোষণ-চোষণের অবাধ নৃত্য, সেখানেই সাম্য ও সমতার তাকবির হেঁকে ফিরে আসে ইসলাম। যেখানে সাম্রাজ্যবাদের বিষদন্ত ক্ষত-বিক্ষত করছে শান্তির পৃথিবী, সেখানেই শান্তি ও সম্প্রীতির জয়নাদ নিয়ে ফিরে আসে ইসলাম। তাই তো দেড় সহস্রাধিক বছর আগেই ইসলাম এই হতভাগ্য শরণার্থীদের অধিকার ও নিরাপত্তা সনদ ঘোষণা করে রেখেছে।

মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর অংশীবাদীদের মধ্যে কেউ তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে, তুমি তাকে আশ্রয় দাও, যাতে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পায়। অতঃপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দাও।’  (সুরা তাওবা, আয়াত : ৬)

ইসলামে শরণার্থী কারা :   ‘Refugee’ বা শরণার্থী শব্দটি মূলত এসেছে ফ্রেঞ্চ  ‘refugie’ শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘আশ্রয় নিতে আসা’। অর্থাৎ ‘refugee’  বা শরণার্থী শব্দটি দ্বারা এমন কাউকে বোঝায়, যে আশ্রয় বা সুরক্ষা চাচ্ছে। আরবিতে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন শব্দ ব্যবহূত হয়। যেমন, ‘ইসতিজারা’ (সুরক্ষার আবেদন) বা ‘লাজা’। বিখ্যাত আরবি অভিধানকারক ইবনে মঞ্জুরের মতে, ‘কোনো কিছুকে কোনো জায়গায় আশ্রয় নেওয়া’। তিনি ব্যাপারটি আরো স্পষ্ট করার জন্য বলেন, ‘আরবি শব্দ ‘লুজু’ দ্বারা ‘শরণাপন্ন হওয়া বা সুরক্ষার সন্ধানে যাত্রা’ বোঝায়।” (ইবনে মনজুর, লিসানুল আরব, পৃষ্ঠা : ১১৫২) অর্থাৎ আরবি লাজা শব্দটি ইংরেজি Refugee শব্দের সমার্থক। এটি দ্বারা এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যিনি আশ্রয়, নিরাপত্তা এবং বাসস্থান খুঁজছেন। তবে মূলত ইসলামে শরণার্থীদের রক্ষার ক্ষেত্রে যে শব্দটি মৌলিক ভিত্তি তা হলো ‘আমান’। এ শব্দ দ্বারা নিরাপত্তা এবং যারা আশ্রয় প্রার্থনা করে তাদের সুরক্ষা বোঝায়। সে কারণেই আশ্রয়প্রার্থী ব্যক্তি ইসলামে ‘মুস্তাআমেন’ (‘আমান’ শব্দ থেকে উদ্ভূত) নামে পরিচিত।

প্রকৃতপক্ষে মুস্তাআমেন ব্যক্তি মুসলিম বা অমুসলিম যা-ই হোক, তাকে আশ্রয় দেওয়ার মূলনীতিই ইসলাম নির্দেশ করে। ওপরে বর্ণিত সুরা তাওবার এই আয়াতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে যায়।

শরণার্থীদের প্রতি সদয় হওয়া যে কতটা সওয়াবের, তা মদিনার আনসারদের ব্যাপারে নাজিল হওয়া আরেকটি আয়াত থেকে আরো স্পষ্ট হয়। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম সারির অগ্রণী আর যারা তাদের যাবতীয় সত্কর্মে অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট আর তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তাদের জন্য তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত যার তলদেশে ঝরনাধারা প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই হলো মহা সফলতা। (সুরা তাওবা, আয়াত ১০০)

তাফসিরবিদদের মতে এই আয়াতে প্রথমত মুহাজিরগণের কথা বলা হয়েছে, যাঁরা দ্বিনের খাতিরে আল্লাহ ও রাসুলের আদেশ পালনার্থে মক্কা ও অন্যান্য এলাকা থেকে হিজরত করে সব কিছু ত্যাগ করে মদিনায় চলে যান। দ্বিতীয়ত আনসারগণ, এরা মদিনার অধিবাসী ছিলেন। এরা সর্বাবস্থায় রাসুল (সা.)-এর সাহায্য ও সুরক্ষা বিধান করেছিলেন এবং মদিনায় আগত মুহাজিরদের যথাযথ সম্মান করেছিলেন এবং নিজেদের সব কিছু তাদের খিদমতে কোরবান করে দিয়েছিলেন। তৃতীয়ত যারা এই প্রথম দুই শ্রেণির লোকদের অনুসরণ করেছিলেন, তাঁদের সবার প্রতি মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট, তিনি তাঁদের জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন।

অতএব দ্বিন প্রতিষ্ঠার জন্য কখনো শরণার্থী হওয়ার প্রয়োজন হলে কিংবা কেউ শরণার্থী হলে তার অধিকার রক্ষা করলে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যায়। তাই আমাদের উচিত, শরণার্থীদের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থাকা।

আজকের বিশ্বে যখন লাখো মানুষ শরণার্থী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে, তখন মুসলমানদের কর্তব্য হলো মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা অনুসরণ করে শরণার্থীদের আশ্রয়, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আসুন, ইসলামের মর্মবাণীকে ধারণ করে শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াই, যাতে মানবতার জয় হয় এবং সমাজ শান্তি ও সহমর্মিতায় ভরে ওঠে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও মুহাদ্দিস  মুফতি সাইফুল ইসলাম

 

 

captcha