IQNA

সৌদি আরবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন ও বিদেশি শ্রমিকদের অবস্থা: (পর্ব-৩)

8:39 - April 10, 2021
সংবাদ: 2612587
তেহরান (ইকনা): গত অনুষ্ঠানে আমরা সৌদি আরবে সংখ্যালঘু শিয়া মুসলমানদের ওপর জুলুম নির্যাতন ও তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বেশ কিছু চিত্র তুলে ধরেছিলাম। আমরা বলেছিলাম সৌদি আরবে সংখ্যালঘু শিয়া মুসলমানদের মসজিদ নির্মাণ কিংবা তাদের কোনো ধর্মীয় স্থাপনা সংস্কারের ওপর কঠোরভাবে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে রাখা হয়েছে। এমনকি শিয়া মুসলমানরা কোনো ভবন নির্মাণ করতে গেলেও বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
সৌদি আরবে শিয়া মুসলমানদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ ও তাদের ধর্ম চর্চার অধিকার হরণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেদেশের শাসকবর্গ ও ধর্মীয় নেতারা শিয়াদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করে। সৌদি আরবে শিয়া মুসলমানদের নিজস্ব ধর্মীয় বা মাজহাব বিষয়ক লিখিত কোনো তথ্য প্রমাণ সংরক্ষণের অনুমতি নেই। এ সংক্রান্ত কোনো গ্রন্থ, তথ্য বা লেখা অন্য দেশ থেকে সৌদি আরবে নেয়ার চেষ্টা করা হলে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। এমনকি শিয়াদের নিজস্ব পদ্ধতিতে আজান দেয়ারও অনুমতি নেই। নিজস্ব মাজহাব অনুসারে শিয়া মুসলমানদের শিক্ষাদিক্ষার অনুমতি না থাকায় তারা ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে শিয়া বিরোধী যে আদর্শিক চিন্তাভাবনার উদয় হয়েছিল রাষ্ট্রিয় পৃষ্টপোষকতায় তা এখন চরম উগ্রতায় রূপ নিয়েছে।
 
নিউইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১৭ সালে এক প্রতিবেদনে বলেছিল, সৌদি আরবের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশ হচ্ছে শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়। তারা সৌদি শাসকবর্গের পক্ষ থেকে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বেশিরভাগ শিয়া মুসলমানের বসবাস দেশটির পূর্বাঞ্চলে এবং প্রায়ই নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে স্থানিয় মুসলমানদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ৬২ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, 'সৌদি আরবের অনেক মুফতি ও সরকারি কর্মকর্তারা শিয়াসহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও উস্কানিমূলক কথাবার্তা ছড়ানোর পাশাপাশি তাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে যা কিনা মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি সম্মান দেখানো বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনের লঙ্ঘন।
 
বাস্তবতা হচ্ছে সৌদি আরবে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বিশেষ করে শিয়া মুসলমানদের সাথে যে আচরণ করা হচ্ছে তা সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সকল রীতিনীতির লঙ্ঘন। এ বিষয়ে জাতিসংঘে বিভিন্ন প্রস্তাব গৃহীত হওয়া ছাড়াও সংখ্যালঘু অধিকার নিয়ে ইউরোপীয় কনভেনশনের ১১ নম্বর ধারায় সংখ্যালঘুদের জন্য উপাসনালয় তৈরি এবং তাদের সন্তানদের নিজস্ব ধর্ম শিক্ষার অধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সংখ্যালঘু অধিকার বিষয়ক বিভিন্ন আইনকানুন থেকে বোঝা যায় আন্তর্জাতিক সমাজ এ বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনের নীতিমালায়ও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংখ্যালঘুদের প্রতি সমর্থন দেয়া হয়েছে যেখানে কোনো বৈষম্য না করার জন্য সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক নীতিমালায় সংখ্যালঘুদেরকে তিনটি মৌলিক অধিকার দেয়া হয়েছে। এক, তাদের বেঁচে থাকার অধিকার। দুই, তাদের সংস্কৃতিক অধিকার এবং তিন নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার।
 
সম্মিলিতভাবে সংখ্যালঘুদের ভাগ্য নির্ধারণের যে অধিকারের কথা বলা হচ্ছে তাতে রাজনৈতিক, সামাজি ও অর্থনৈতিক অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। নিজের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার মানবাধিকারের অন্যতম প্রধান মূল নীতি। জাতিসংঘের ঘোষণা পত্রে সব দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সমাজের সব মানুষের অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমরা যদি সৌদি আরবের অবস্থার দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব সেদেশের শাসকগোষ্ঠী জনগণকে নির্বাচন থেকে দূরে রেখে তাদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। যদিও সীমিত আকারে পৌরসভা নির্বাচনের ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু দুই তৃতীয়াংশ প্রার্থী সরকার নির্ধারণ করে থাকে। ফলে এ রকম একটি ব্যবস্থায় সংখ্যালঘুদের ইচ্ছার প্রতিফলন হওয়ার সুযোগ নেই।
 
বাস্তবতা হচ্ছে, সৌদি আরবের আইন ও শাসন ব্যবস্থায় সংখ্যালঘু অধিকার বলতে কিছু নেই বরং সবসময়ই তারা হুমকির মুখে রয়েছে। বিশেষ করে শিয়া মুসলিম সম্প্রদায় সবচেয়ে বিপদের সম্মুখীন। আরবি ভাষায় কথা বলার দিক থেকে ইরাকের পর সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক শিয়া মুসলমান বাসবাস করে।
 
কিন্তু তারাই সবেচেয়ে বেশি জুলুম ও বঞ্চনার শিকার। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের জায়গা নেই। এমনকি নিজ এলাকার পরিচালনার অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত। আর সৌদি আরবের নাগরিক হয়েও রাষ্ট্র ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদ তাদেরকে দেয়া হয় না। যদিও কখনো কখনো মন্ত্রিসভার দু একটি পদ শিয়া মুসলমানকে দেয়া হয় কিন্তু নীতি নির্ধারণের কোনো ক্ষমতা তাদের নেই। এর বাইরে বিচার বিভাগে, সেনাবাহিনীতে, নিরাপত্তা বিভাগে ও ন্যাশনাল গার্ড বাহিনীতে শিয়া মুসলমানদের কোনো স্থান নেই। ইরানের খাওয়ারেজমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.কাদির নাসেরি বলেছেন, সৌদি আরবের বিশ্ববিদ্যালয়, দূতাবাসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ওয়াহাবিরা। আল আহসা প্রদেশের শিয়ারা সেখানকার প্রাথমিক স্কুলের উপপ্রধান পদ থেকে বঞ্চিত। কেবলমাত্র সরকারের একান্ত অনুগত ব্যক্তিদেরকেই এসব পদে বসানো হয়। সৌদি শাসকগোষ্ঠী ও ওয়াহাবি ধর্মীয় নেতাদের একটি অভিন্ন নীতি হচ্ছে তারা শিয়া মুসলমানদেরকে কখনই আপন ভাবতে পারে না এবং শিয়াদের যে কোনো কর্মকাণ্ডকে ষড়যন্ত্র বলে মনে করে।
 
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়া জুড়ে ইসলামি জাগরণ শুরু হওয়ার পর সৌদি আরবের শিয়া মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি জুলুম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে আন্দোলনকারী বহু শিয়া মুসলমানকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে শুধু সরকারের নীতির সমালোচনা করার অপরাধে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও খ্যাতানামা শিয়া আলেম আয়াতুল্লাহ নিমর বাকের আল নিমরকে শিরোচ্ছেদ করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। 
 
সৌদি আরবের কাতিফে সংখ্যালঘুদের অধিকার হরনের প্রতিবাদে ২০১১ সালে সেখানকার শিয়া মুসলমানরা সরকার বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ করে। বিক্ষোভ দমাতে নিরাপত্তা বাহিনী ৯০০ এর বেশি লোককে গ্রেফতার করে যাদের মধ্যে ৩০০ ব্যক্তি এখনো জেলখানায় আটক রয়েছে। এদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করার দায়ে অনেককে ফাঁসির হুকুম দেয়া হয়েছে। ২০১৪ সালে যার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে আটকের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৭।
 
সৌদি আরব শুধু যে শিয়া মুসলমানরাই জুলুম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাই নয় একইসঙ্গে সেখানে বসবাসকারী সুন্নি মুসলমানরা ও বিদেশি শ্রমিকরাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পার্সটুডে
captcha