IQNA

লবণাক্ত পানি শোধনে ইসলামী বিজ্ঞান

10:28 - July 13, 2025
সংবাদ: 3477698
ইকনা- প্রাকৃতিক পানি বিভিন্ন ধরনের হয়। যার কিছু বিশুদ্ধ, কিছু ঘোলা, কিছু খনিজ স্বাদের আর কিছু লবণাক্ত। ফলে প্রাচীনকাল থেকে পানি পান করা এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহারের উপযুক্ত করতে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে থাকে। পানির লবণাক্ততা দূর করার চেষ্টা গ্রিকরাই প্রথম করেছিল।
আরবদের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল গ্রিকদের বই অনুবাদের মাধ্যমে। পানির লবণাক্ততা দূর করার ব্যাপারে ইবনে রুবিন তাবারি লেখেন, ‘দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, লবণাক্ত পানির তুলনায় লবণমুক্ত পানি হালকা। এর প্রমাণ হলো, আপনি যদি মোমের একটি ফাঁপা পাত্র তৈরি করেন, যার মুখ নেই এবং তা এক দিন ও এক রাত সমুদ্রে রাখেন, তবে তার ভেতর আপনি লবণমুক্ত পানি পাবেন। ঘনত্বের কারণে লবণাক্ত পানি তাতে প্রবেশ করতে পারে না।
 
 
প্রাচীনকালে পানির লবণাক্ততা দূর করার আরেকটি পদ্ধতি ছিল লবণাক্ত পানির ভেতর ভিন্ন উপাদান মিশ্রণ করা। আধুনিক যুগেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। প্রাচীনকালে পানির লবণাক্ততা কমাতে বিভিন্ন ধরনের উপাদান মেশানো হতো। এই পদ্ধতির প্রথম ধারণা দেন গ্যালেন।
 
 
তিনি বলেন, পানি যদি লবণাক্ত হয় তবে তাতে শামি ক্যারব (তেঁতুলসদৃশ ফল), মেদিগাছের ফল, হাউথর্ন, খুজাই ও গ্রুয়েল মেশাতে হবে। কেননা এগুলো পানিকে মিষ্টি হতে সাহায্য করে। মুসলিমরা এই পদ্ধতির ওপর গবেষণা করেছেন এবং তার উন্নয়নে কাজ করেছেন। ইবনে ওয়াশহিয়্যা তাঁর ‘কিতাবুল ফাল্লাহাতিন নাবাতিয়্যা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘তিক্ত লবণাক্ত পানির ক্ষতি থেকে বাঁচতে লাল আঠালো মাটি শুকিয়ে তা লবণাক্ত পানির ভেতর ছেড়ে দেওয়া হয় এবং এক ঘণ্টা পর তা পরিশোধন করে খাওয়া হয়। অথবা একটি নতুন ইটের টুকরা পানির ভেতর ছেড়ে দিয়ে দুই ঘণ্টা রেখে দেওয়া হয় এবং তা পান করা হয়।
 
 
সাবিত বিন কুররা লেখেন, ‘যে ভ্রমণকারী পানি পান করতে চায় এবং পানি যদি লবণাক্ত হয়, তবে সে পানির সঙ্গে সাকাংবিন (মধু ও ভিনেগার মেশানো বিশেষ পানীয়) মেশাবে, বা কিছু ভিনেগার অথবা এতে শামি ক্যারব (তেঁতুলসদৃশ ফল) বা মেদি গাছের ফল বা হাউথর্ন অথবা পরিষ্কার মাটি মেশাবে।’ চিকিৎসক আল রাজি পানি লবণমুক্ত করার পদ্ধতিকে এভাবে তুলে ধরেছেন, ‘লবণাক্ত পানির লবণাক্ততা দূর করার জন্য এতে লবণমুক্ত মাটি বা নতুন ইট বা রান্নার কাজে ব্যবহৃত মাটির পাত্র ডুবিয়ে দিতে হবে। এরপর তা পরিশোধন করে পান করতে হবে।’
 
উমাইয়া যুগে কোরআন, হাদিস ও ফিকহের মতো ইসলামী বিষয়ের বাইরে গিয়ে জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় মনোযোগী হয়েছিলেন মুসলিম মনীষীরা। মুসলিম বিশ্বে আধুনিক জ্ঞানচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন খালিদ বিন ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া। তিনি বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রিক বইগুলো অনুবাদের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি সমুদ্রের লবণাক্ত পানি লবণমুক্ত করার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। ঐতিহাসিক ইবনে আসাকির এ বিষয়ে একটি চমৎকার ঘটনা বর্ণনা করেন। খালিদ বিন ইয়াজিদ একদিন উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের দরবারে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সেখানে পানি বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। খালিদ তখন বলেন, কিছু পানি আসে আকাশ থেকে; আর কিছু পানি মেঘ সমুদ্র থেকে উঠিয়ে নেয় এবং তা বিদ্যুৎ ও আলোর সাহায্যে মিষ্টি করা হয়। চিন্তার বিষয় হলো, কোনো উদ্ভিদ সমুদ্রের পানি থেকে জন্মায় না, তা আকাশ থেকে বর্ষিত পানি থেকে জন্মায়। এপর তিনি বলেন, যদি আপনারা চান তবে আমি সমুদ্রের পানি কিভাবে মিষ্টি হয় তা দেখাতে পারি। এরপর তিনি সাগর থেকে পানি নিয়ে আসেন এবং তা কিভাবে মিষ্টি হয় তা দেখান।
 
সম্ভবত ইসলামের ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম পানি বাষ্পীকরণ পদ্ধতিতে লবণমুক্ত করার প্রচেষ্টা।
 
আল্লামা ইবনে আসাকির খালিদ কিভাবে পানি লবণমুক্ত করেছিলেন তা বিস্তারিত উল্লেখ করেননি। তবে ধারণা করা হয়, তিনি একটি সমতল পাত্রে পানি রেখে তা কাচের পাত্র দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। অতঃপর সূর্যের তাপে রেখে দিয়েছিলেন। ফলে সূর্যের তাপে (লবণমুক্ত হয়ে) পানি বাষ্প হয়ে কাচের পাত্রে একত্র হয়েছিল।
 
মুসলিম রসায়নবিদ জাবির ইবনে হাইয়ান পানির লবণাক্ততা দূরকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর একটি বড় অবদান হলো বিশুদ্ধ পানি ও রাসায়নিক পদার্থ আলাদা করতে পাতন (distillation) পদ্ধতির বিকাশ, যা পরবর্তী সময়ে আধুনিক পাতন পদ্ধতির মূল ভিত্তি হিসেবে অবদান রাখছে। জাবির ইবনে হাইয়ান এমন একটি কাচের পাতনযন্ত্র উদ্ভাবন করেন, যেটি পরে আলেম্বিক (alembic) নামে পরিচিত হয়। এই যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি দুই ধরনের পাতন পদ্ধতির বর্ণনা দেন, একটি হলো শুষ্ক পাতন এবং অন্যটি আর্দ্র পাতন বা সাবলিমেশন।
 
শুষ্ক পাতন (Dry Distillation) : জাবিরের বর্ণনা অনুযায়ী, এই পদ্ধতিতে একটি লোউক আকৃতির পাত্রে পানি রাখা হয়, যার মাঝখানে বাঁশের খণ্ড দিয়ে তৈরি একটি রিং স্থাপন করা হয়। এই রিং বাষ্পকে সরাসরি বের হতে বাধা দেয় এবং ফিল্টারের মতো কাজ করে। পরে পাত্রের মুখ সুতায় ও তুলায় সিল করে একটি আলেম্বিক যুক্ত করা হয়। অল্প আঁচে গরম করলে পানি বাষ্পীভূত হয়ে আলেম্বিকের মাধ্যমে ঘনীভূত হয়ে বিশুদ্ধ পানিরূপে সংগ্রহ করা যায়। আধুনিক ভাষায় এটাকে সাধারণ বাষ্পীভবন ও ঘনীভবন প্রক্রিয়া বলা হয়।
 
আর্দ্র পাতন বা সাবলিমেশন পদ্ধতি (Moist Distillation/Sublimation) : দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো, জাবির একটি পাত্রে পানি রেখে সেটিকে এমনভাবে একটি কড়াইয়ের গরম পানির মধ্যে ঝুলিয়ে রাখেন, যেন তা কড়াইয়ের তলার সঙ্গে স্পর্শ না করে। এরপর কড়াইয়ের পানি প্রচণ্ডভাবে উত্তপ্ত করলে এর বাষ্পের তাপে ঝুলন্ত পাত্রের পানিও বাষ্পীভূত হয় এবং তা আলেম্বিকের মাধ্যমে ঘনীভূত হয়ে সংগ্রহ করা যায়। এই পদ্ধতিটি আধুনিক স্টিম পাতন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনীয়, যেখানে পরোক্ষ তাপের মাধ্যমে পদার্থকে বিশুদ্ধ করা হয়।
 
জাবির ইবনে হাইয়ান শুধু পাতন পদ্ধতিই ব্যাখ্যা করেননি, তিনি জলীয় অমিশ্রণ বিশ্লেষণ করে দেখান যে পরিশ্রবণ (filtration) কেবল দৃশ্যমান, বড় কণাগুলো সরাতে সক্ষম, অথচ পাতন সূক্ষ্ম, দ্রবীভূত ও কখনো জৈব উৎসর মিশ্রণকেও দূর করতে পারে। জাবিরের পাতন পদ্ধতি পরবর্তীকালে আধুনিক সমুদ্রজল পাতন কারখানা ও বহু ধাপ পাতন ইউনিট (multi-effect evaporator) নির্মাণে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রাথমিকভাবে এটি একক ধাপে পাতনকারী (single-effect evaporator) আকারে ব্যবহার হলেও পরে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে একাধিক ইউনিটের সাহায্যে চিনিশিল্প, লবণ নিষ্কাশন ও পানিশোধন প্রযুক্তিতে বিস্তৃতভাবে প্রয়োগ হয়।
 
বিশ্বখ্যাত ফরাসি মনীষী গুস্তাভ ল্য বঁ তাঁর রচনায় উল্লেখ করেছেন, ‘জাবির ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি পাতন, স্ফটিকীকরণ, দ্রবণ ও
 
রূপান্তর প্রক্রিয়ার মৌলিক দিকগুলো তাঁর লেখায় উপস্থাপন করেন।’ এই বক্তব্য প্রমাণ করে যে মুসলিম বিশ্বের বাইরেও জাবিরের অবদান গভীরভাবে প্রশংসিত এবং পরবর্তীকালে ইউরোপীয় রসায়নের ভিত্তি নির্মাণে সহায়ক হয়।
লেখক: মো. আবদুল মজিদ মোল্লা
তথ্যঋণ : মুসলিম হেরিটেজ ডটকম

 

captcha