IQNA

রোবট তৈরি করছে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা

17:54 - March 16, 2023
সংবাদ: 3473483
তেহরান (ইকনা): জামিয়া বাইতুস সালাম তালাগং। পাকিস্তানের পাঞ্জাবে অবস্থিত একটি আধুনিক দ্বিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেখানে শিক্ষার্থীরা একই সঙ্গে ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষা লাভ করে থাকে। ধর্মীয় ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের সাফল্য ঈর্ষণীয়। 
কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও তারা সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে। জামিয়া বাইতুস সালাম করাচিভিত্তিক বাইতুস সালাম ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের একটি প্রতিষ্ঠান। বাইতুস সালাম ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট সম্পূর্ণ একটি অলাভজনক দাতব্য প্রতিষ্ঠান, যা ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ট্রাস্টের অধীনেই ২০১৩ সালে জামিয়া বাইতুস সালাম যাত্রা শুরু করে।
 
বাইতুস সালামের বহুমুখী কার্যক্রম : বাইতুস সালাম ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের প্রধান কর্মসূচি তিনটি : ১. বাইতুস সালাম এডুকেশন সার্ভিস, ২. বাইতুস সালাম হিউম্যানিটিরিয়ান অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সার্ভিস, ৩. বাইতুস সালাম পাবলিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া সার্ভিস। এই তিনটি শাখার প্রত্যেকটির অধীনে একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন বাইতুস সালাম পাবলিকেশন, বাইতুস সালাম এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন, রওজাতুল ইসলাম, বেসিক ট্যালেন্ট স্কুল, জামিয়া বাইতুস সালাম তালাগং, জামিয়া বাইতুস সালাম করাচি, বাইতুস সালাম বেসিক হেলথ ইউনিট, বাইতুস সালাম ফুড ব্যাংক, মাসাজিদ কনস্ট্রাকশন ইত্যাদি।
 
বিশাল শিক্ষাবৃত্তি : বাইতুস সালাম এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন পাকিস্তানের ৫০ হাজার শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়ে থাকে। এর মধ্যে ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী বাইতুস সালাম পরিচালিত ৩৮০ শিক্ষাকেন্দ্রে লেখাপড়া করে। আর তাদের ১২ হাজারই আবাসিক।
 
বিস্ময়কর এক মাদরাসা : জামিয়া বাইতুস সালাম তালাগংকে সময়ের এক বিস্ময় বললে মোটেও ভুল হবে না। কেননা এখানে একই সঙ্গে একজন শিক্ষার্থী দরসে নিজামি (কওমি শিক্ষাক্রম) ও ইংলিশ মিডিয়ামের কারিকুলাম সম্পন্ন করে। আর শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষাসেবা পেয়ে থাকে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে। জামিয়া বাইতুস সালাম তালাগংয়ে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। তাদের পাঠদান করেন শতাধিক শিক্ষক। সম্পূর্ণ দ্বিনি, স্বাস্থ্যকর ও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশে পাঠদান করা হয়।
 
জামিয়া বাইতুস সালামে শিক্ষার্থীরা পবিত্র কোরআন হিফজ করার পাশাপাশি ইংলিশ মিডিয়ামের ও-লেভেল এ-লেভেল সম্পন্ন করে। এরপর তাদের দরসে নিজামির তাকমিল (দাওরা হাদিস) পর্যন্ত পাঠ দান করা হয়। এখানে শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়গুলো শিখতে পারে। যার মধ্যে আছে গণিত, রসায়ন, পদার্থ, জীববিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত ছাড়াও কম্পিউটার সায়েন্স, রবোটিকস, কোডিং, প্রগ্রামিং, ওয়েবডিজাইন, ভিডিও এডিটিং ইত্যাদি।
 
প্রাতিষ্ঠানিক কারিকুলামের বাইরে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা, ইসলামী সংগীত, ক্যালিগ্রাফি, আত্মরক্ষামূলক মার্শালআর্ট, বিতর্ক ইত্যাদিতে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। মাতৃভাষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আরবি ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ করে তোলা হয়। শিক্ষার্থীদের ভেতর মানবিক মূল্যবোধ তৈরি করতে তাদের সামাজিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করানো হয়।
 
যেভাবে সাজানো হয়েছে শিক্ষাক্রম : শিশুরা ভর্তির পর প্রথমে হিফজুল কোরআনের পাশাপাশি ও-লেভেল সম্পন্ন করে। ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সের মধ্যে তারা ও-লেভেল শেষ করে। এরপর তারা প্রয়োজনীয় দ্বিনি শিক্ষার পাশাপাশি চার বছরে এ-লেভেল শেষ করে। এ-লেভেল শেষ করার পর যার ইচ্ছা সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং যার ইচ্ছা সে দরসে নিজামিতে ভর্তি হয়। কেউ ও-লেভেল বা এ-লেভেলে পাস করতে না পারলে পাকিস্তানের স্থানীয় শিক্ষাবোর্ডের অধীনে তার পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
 
রোবট তৈরি করছে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা : জামিয়া বাইতুস সালামের শিক্ষার্থীরা সমানভাবে ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষায় সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে। বিশেষত রোবোটিকসে তাদের সাফল্য পাকিস্তানে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কেননা বাইতুস সালামের শিক্ষার্থীরা চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসলামাবাদের ‘ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ আয়োজিত রোবোকাস্ট-২৩ পুরস্কার জেতে। এতে মেইজ সলভার বিভাগে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান এবং লাইন সলভার বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে; চলতি বছরের জানুয়ারিতে আয়োজিত মিসমো জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডে স্থানীয় পর্যায়ে শীর্ষ ১০টি স্থান এবং জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে; লাহোর বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ইনোভেশন অলিম্পিয়াডে বাইতুস সালামের শিক্ষার্থীরা  রোবটিকস বিভাগে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান এবং মডেল ইউনাইটেড ন্যাশনস বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে; পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের ‘ইয়ুথ রোবটেক কম্পিটিশন’-এ পাঁচ শ দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এখানে তারা পাঁচটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে করে চারটিতে প্রথম এবং একটিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। এ ছাড়া জামিয়ার ও-লেভেলের শিক্ষার্থী উসমান গনি ‘চিফ কমিশনার আইসিটি স্ক্রবল চ্যাম্পিয়নশিপে’ প্রথম স্থান অধিকার করে। গত বছরের ডিসেম্বরে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল।
 
পিছিয়ে নেই ধর্মীয় শিক্ষায় : তাই বলে ধর্মীয় শিক্ষায় পিছিয়ে নেই বাইতুস সালামের শিক্ষার্থীরা। গত বছর পাকিস্তানের মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের কেন্দ্রীয় পরীক্ষার স্থানীয় পর্যায়ের মেধা তালিকায় ছয়জন এবং জাতীয় পর্যায়ের মেধা তালিকায় চারজন শিক্ষার্থী স্থান করে নিয়েছে।
 
এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের মানসিক গঠনের জন্য প্রতি মাসে মাদরাসায় বিশেষ ‘তারবিয়াতি মজলিস’-এর আয়োজন করা হয়। ধর্মীয় বিষয়গুলোর মধ্যে হামদ, নাত, কেরাত, হিফজুল কোরআন, আরবি হাতের লেখা, বক্তৃতা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সম্প্রতি বাইতুস সালামের শিক্ষার্থীদের ইসলামী শিল্পকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শরিয়াহ আদালতের মসজিদ অলংকৃত করা হয় ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আঁকা ক্যালিগ্রাফি দ্বারা।
 
সাফল্যের রহস্য : জামিয়া বাইতুস সালাম বলছে, আগামীর জন্য একদল দেশপ্রেমিক যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলাই তাদের লক্ষ্য। যারা নিজের ব্যক্তিগত উন্নয়নের জন্য শিক্ষার্জন করবে না; বরং তারা মাতৃভূমি ও মুসলিম উম্মাহর জন্য বড় হবে। দেশপ্রেমের এই দীক্ষাই জামিয়া বাইতুস সালামের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। এর পাশাপাশি শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ, শিক্ষা উপকরণের পর্যাপ্ত সরবরাহ, একদল যোগ্য ও দক্ষ তরুণ শিক্ষকের অক্লান্ত পরিশ্রম এই প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
 
তথ্যঋণ : বাইতুস সালাম ডটঅর্গ, জামিয়া বাইতুস সালামের ফেসবুক পেইজ, ইউটিউব চ্যানেল ও প্রবন্ধ : বাইতুস সালাম টা কাবেলে ইকতিদা তালিমি মডেল
 
 
ক্যাম্পাসে রোবট তৈরি করছে শিক্ষার্থীরা
captcha