সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর গণহত্যার খবর সারা বিশ্বের মানবদরদী মানুষ ও সচেতন মুসলমানদের মর্মাহত করেছে। এ গণহত্যার কারণ ও পটভূমি নিয়ে ইসলামপন্থী মহলসহ নানা মহলে চলছে বিভিন্ন জল্পনা-কল্পনা ও বিশ্লেষণ। গণমাধ্যমগুলোতেও তুলে ধরা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বিশ্লেষণ।
মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সম্প্রতি যে গণহত্যা পরিচালিত হয়েছে তার পেছনে বা নেপথ্যের গুরু কারা এবং তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দশ্যগুলো কী তা জানা বা বোঝার চেষ্টা করা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সব মহল ও বিশেষ করে এই অঞ্চলের মুক্তিকামী সচেতন নাগরিকদের জন্য খুবই জরুরি।
সাম্প্রতিক এই গণহত্যায় ঠিক কতজন রোহিঙ্গা মুসলমান শহীদ হয়েছেন তা এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে এটা স্পষ্ট যে এই সংখ্যা অন্তত কয়েক হাজার হবে এবং এমনকি নিহতের সংখ্যা ৫০ হাজারও ছাড়িয়ে গেছে বলে কোনো কোনো রোহিঙ্গা সূত্র দাবি করেছে।
লক্ষনীয় ব্যাপার হল, সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টনের সফরের ২/৩ দিন পরই পরিকল্পিত গণহত্যার এই ঘটনাগুলো ঘটেছে। হিলারি ওই সফরে এই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রক্রিয়া সন্তোষজনক। আর এর পরই মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন যে, তার দেশ থেকে দশ লাখ রোহিঙ্গাদেরকে বিতাড়িত করাই এ সংকটের একমাত্র সমাধান।
জানা গেছে, প্রথমদিকে গণহত্যায় লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল রাখাইন উপজাতিকে। পরে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীও হত্যাযজ্ঞে শরিক হয় এবং রাখাইনদেরকে হত্যা অভিযানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব ধরনের সহযোগিতা দেয়। ষড়যন্ত্রকারীরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের এলাকায় একজন রাখাইন মহিলার লাশ রেখে এসে প্রচার করে যে, রোহিঙ্গারা তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করেছে। আর এভাবে বৌদ্ধ রাখাইনদেরকে ক্ষেপিয়ে তোলা হয় রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে।
রোহিঙ্গা মুসলমানরা শত শত বছর ধরে মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে বসবাস করছে। মিয়ানামারের সামরিক সরকার ১৯৮২ সালে এক বিতর্কিত আইন পাশ করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করার ঘোষণা দেয়। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মার্কিন সরকার
ও সাম্রাজ্যবাদী মহলের কয়েকটি সম্ভাব্য নীলনক্সা:
বুড়ো শয়তান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মত মার্কিন সরকারও "ডিভাইড এন্ড রুল "নীতি বা ভাগ করে শাসন কর' নীতির প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামকে এবং ভারতের মিজোরামকে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন সরকার ও তার দোসরদের মহাপরিকল্পনা রয়েছে বলে অনেক দূরদর্শি বিশ্লেষক মনে করছেন। সাম্প্রতিক সময়ের রোহিঙ্গা সংকট সম্ভাব্য সেই মাস্টারমানের একটা অংশ হতে পারে বলে তারা মনে করেন।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, টেকনাফ ও চট্টগ্রাম বন্দর অঞ্চলসহ আশপাশের অঞ্চলগুলোর ব্যাপক কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। বঙ্গোপসাগরসহ এ অঞ্চলে গ্যাস ও তেলের খনি থাকার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়াও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এ অঞ্চল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই মার্কিন সরকার সেন্ট মার্টিন দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি করতে চেয়েছিল। এ জন্য বাংলাদেশের ততকালীন সরকার প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছিল হোয়াইট হাউজ। মার্কিন সরকার বলেছিল, এর বিনিময়ে শেখ মুজিব যাযা চাইবেন তার সবই তাকে দেয়া হবে। কিন্তু সে সময় বাংলাদেশের ওপর দিল্লি ও মস্কোর ব্যাপক প্রভাব থাকায় মুজিব সরকার এই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। শেখ মুজিব আওয়ামীলীগের অন্য অনেক নেতার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি স্বাধীনচেতা ও দেশপ্রেমিক ছিলেন বলে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের জন্য চক্ষুশূল হয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে দিল্লি ও ওয়াশিংটন খুশি হয়েছিল বলেই
বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছে করলে মুজিব হত্যা ঠেকাতে পারত, কিন্তু তা সত্বেও শেখ মুজিবের পতনের ব্যাপারে দিল্লি এবং ওয়াশিংটনের নীতিগত অভিন্নতা ছিল স্পষ্ট।
যাই হোক, এই দ্বীপে ও এমনকি চট্টগ্রাম বন্দরে ঘাঁটি করার মার্কিন প্রচেষ্টা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যু এবং ভারতের সেভেন সিস্টারের স্বাধীনতাকামী ও জাতীয়তাবাদী ততপরতার পরস্পরের ওপর প্রভাব ফেলার মত বিষয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারত ভবিষ্যতে বড় ধরনের পরাশক্তি হয়ে উঠুক, মার্কিন সরকারের তা কাম্য নয়। যদিও দিল্লি-ওয়াশিংটন সম্পর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাহ্যিক দিক থেকে ক্রমেই জোরদার হয়ে উঠছে, কিন্তু একটা সময়ে দিল্লি এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বেইজিং-ওয়াশিংটন দ্বন্দ্বের মতই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। দিল্লি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হোক সেটাও ওয়াশিংটন কখনও চাইবে না। এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনের মনের কথা ও কলা ঝুলিয়ে লোভ দেখানোর প্রবণতার মধ্যে পার্থক্য করা উচিত।
একদলবিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ টুকরো টুকরো হয়ে যাক সেটাও হয়ত ওয়াশিংটনের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। তবে ভাঙ্গনটা শুরু হতে পারে বাংলাদেশ বা মিয়ানমার থেকেই।
বাংলাদেশের পার্বত্য উপজাতিগুলোর মধ্যে রাখাইনও রয়েছে। তারা কক্সবাজার ও টেকনাফের মত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বসবাস করে। ভবিষ্যতে রাখাইনরা মিয়ানমারের আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের পুরোপুরি বিতাড়িত করলে চট্টগ্রামের রাখাইনরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার যাতে রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের ও রাখাইনদের আগ্রাসী ততপরতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য রোহিঙ্গাদেরকে আগেই এ অঞ্চল থেকে অনেক দূরে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বা হবে, অথবা তাদের বেশিরভাগকেই হত্যা করা হবে বলে একদল বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা করছেন। এ অবস্থায় বাংলাদেশের ও মিয়ানমারের রাখাইনসহ এ অঞ্চলের পার্বত্য উপজাতিদের নিয়ে আরকান, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম বন্দর, সেন্টমার্টিন ও চট্টগ্রামের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নিয়ে একটি স্বাধীন দেশ গঠনের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারে মার্কিন সরকার, ইসরাইল ও তার পশ্চিমা সহযোগীরা। এ রকম একটি স্বাধীন দেশ নীতি- আদর্শ ও আচরণের দিক থেকে ইসরাইলের মতই আগ্রাসী হবে এবং দেশটি হবে মার্কিন সরকারের জন্য এ অঞ্চলের ওপর ছড়ি ঘোরানোর মাধ্যম।
ভারতের সেভেন সিস্টার ও বিশেষ করে মিজোরামকে নিয়েও মার্কিন সরকারের একই ধরনের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকতে পারে। উল্লেখ্য ভারতের মিজোরামে খ্রিস্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাদেশের উপজাতিগুলোর মধ্যেও খ্রিস্টানদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সম্ভবত ভারতের নাগাল্যান্ডেও খ্রিস্টান মিশনারীরা ততপর রয়েছে এবং সেখানেও হয়ত ছড়িয়ে পড়ছে খ্রিস্টানরা।
ভারত ও বাংলাদেশকে ভেঙ্গে ছোট ছোট কয়েকটি স্বাধীন দেশ করার নীল নক্সা থাকতে পারে মার্কিন সরকারের। আর এটা অদূর ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
অন্যদিকে চীনও হয়ত চায় ভারত ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাক। মিয়ানমারের সাথে চীনের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তবে মিয়ানমারের বর্তমান সরকারের সঙ্গে পাশ্চাত্যের সখ্যতা ক্রমেই বাড়ছে। ইহুদিবাদী ইসরাইল মিয়ানমারকে অস্ত্রের যোগান দিয়ে আসছে বলে জানা গেছে। তবে ওয়াশিংটন ও পাশ্চাত্য চীনকে ঠেকানোর জন্য আপাতত ভারতকে ব্যবহার করতে চায়। ভারতের বিশাল বাজারও পাশ্চাত্যের জন্য বেশ লোভনীয়। তাই ভারত ও চীনের বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদদের উচিত পাশ্চাত্যের মাধ্যমে ব্যবহৃত না হওয়া বরং এ অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা যাতে মার্কিন সরকার বা পাশ্চাত্য এ অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে বসতে না পারে বা তারা চীন ও ভারতসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতি করতে না পারে।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, মার্কিন সরকার যদি এ অঞ্চলে বাংলাদেশ ও ভারতকে ভেঙ্গে এক বা একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে তাহলে সেখানে খ্রিস্টানদেরকেই ক্ষমতায় বসাবে।
বৌদ্ধ বা মুসলমানদেরকে হয়ত ক্ষমতার সামান্য অংশ দিবে, কিন্তু ক্ষমতার সিংহভাগই থাকবে খ্রিস্টানদের হাতে।
মার্কিন সরকার, ইসরাইল ও পাশ্চাত্য এ অঞ্চলে রোহিঙ্গাদেরকে নিয়েও বিপজ্জনক খেলা খেলতে পারে:
ওয়াশিংটন, ইসরাইল ও পাশ্চাত্য রোহিঙ্গা জাতীয়ভাবাদীদের উস্কে দিয়ে গোটা আরাকান বা আরাকানের অংশ বিশেষ ও চট্টগ্রামকে নিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করতে পারে। এমন একটি রাষ্ট্র গঠিত হলে সেখানে রোহিঙ্গা জাতীয়তাবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষ রোহিঙ্গাদেরকেই ক্ষমতায় বসাবে। ইসলামপন্থী রোহিঙ্গারা সেখানে কোনো মর্যাদাই পাবে না। বহু আগেই গঠিত হয়েছে রোহিঙ্গাদের জাতীয়তাবাদী দল। তারা মনে করে গোটা চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজ্যের অংশ। মোগল আমলের আগে চট্টগ্রাম বৃহত্তর বাঙ্গালার অংশ ছিল না। আরাকান ও চট্টগ্রাম ছিল বৌদ্ধ মগ রাজাদের শাসনাধীন। আর এ জন্যই একদল উগ্ন রোহিঙ্গা জাতীয়তাবাদী মনে করে চট্টগ্রামকে নিয়েই স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রাম করতে হবে এবং চট্টগ্রাম থেকে বাংলাদেশি বা বাঙ্গালীদের বিতাড়িত করতে হবে।*
তবে মার্কিন যে প্ল্যানটি বাস্তবায়নের আশঙ্কা বেশি তা হল, রাখাইনদের দিয়ে গোটা আরাকান ও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার একটা বিশাল অংশ ও গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করে নেয়া এবং এই ভূখণ্ডটিকে স্বাধীন করে দেয়া। এ জন্য মার্কিন এজেন্টরা প্রথমে হয়তো একদল রাখাইনকে হত্যা করে এর দায় চট্টগ্রামের বাঙ্গালীদের ওপর চাপিয়ে দিবে। আর এই অজুহাতে রাখাইনদেরকে ক্ষিপ্ত করবে বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে। ওয়াশিংটন তাদেরকে উন্নত অস্ত্র শস্ত্র দিয়ে বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা শুরু করবে। মারা যাবে হাজার হাজার বা লাখ লাখ বাঙ্গালি।
এরপর বাংলাদেশ সরকার হয়তো বাঙ্গালিদের রক্ষার জন্য সেখানে সেনাবাহিনী পাঠাবে। কিফ সেনাবাহিনী সেখানে যাওয়ার পরই জাতিসংঘকে দিয়ে অস্ত্র বা যুদ্ধ বিরতি মেনে নিতে বাংলাদেশ সরকারকে বাধ্য করবে পাশ্চাত্য। ফলে বাংলাদেশ সেখান (চট্টগ্রাম) থেকে সেনা সরিয়ে আনতে বাধ্য হবে। এরপর সেখানে গণভোট দেবে জাতিসংঘ। গনভোটে পূর্ব তিমুরের মত চিরতরে বাংলাদেশ থেকেও বিচ্ছিন্ন করা হবে প্রায় পুরো চট্টগ্রাম।
বাংলাদেশ সরকার বা বাঙ্গালিরা কি এইসব সম্ভব্য ষড়যন্ত্র ও সেগুলো মোকাবেলার উপায় সম্পর্কে সচেতন? সক্ত লারমারা মাঝে মধ্যেই সংগ্রামের হুমকি দিচ্ছেন। রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার পর সাম্প্রতিক সময়েও এ ধরনের হুমকি দিয়েছেন উপজাতীয় এই নেতা।
রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সম্ভবত সাম্রাজ্যবাদ মহল এক ঢিলে নানা পাখি শিকারের চেষ্টা করছে।
লেখক:
ইসলামী চিন্তাবিদ এবং গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান
এবং মোহাম্মাদ আমির হোসাইন