IQNA

কোরআনে পরিবেশনীতির বিবরণ

21:28 - May 25, 2025
সংবাদ: 3477435
ইকনা- বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। বরফ গলছে, সমুদ্রের স্তর বিস্তৃত হচ্ছে। একদিকে অতিবৃষ্টি, অন্যদিকে খরা। উজাড় হচ্ছে বন, নিধন হচ্ছে বন্যপ্রাণী, বৃদ্ধি পাচ্ছে বাতাসের দূষণ।
সব মিলিয়ে মানবসভ্যতা আজ এক অদৃশ্য ভয়াবহতার সম্মুখীন। দুনিয়ার বিজ্ঞানাগারগুলোর এই সংকট সমাধানে বিরতিহীন কাজ করা হচ্ছে। অথচ ইসলাম তার ভিত্তিগ্রন্থ কোরআনের মাধ্যমে পরিবেশনীতির গভীর দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছে অনেক আগেই।
বলা যায়, কোরআন পরিবেশনীতির এক অসাধারণ ভাণ্ডার।
 
 
যেখানে প্রকৃতিকে কেবল সম্পদ নয়, বরং একটি আমানত (trust) হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা সংরক্ষণ করা ঈমানদারের অন্যতম দায়িত্ব।
প্রকৃতির ভারসাম্য বা মিজান
 
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত, এবং স্থাপন করেছেন মিজান (তুল্যতা), যাতে তোমরা সীমা লঙ্ঘন না করো মিজানে।’ (সুরা : আর-রাহমান, আয়াত : ৭-৮)
 
এই আয়াতে ‘মিজান’ মানে কেবল পরিমাপ নয়। এটি একটি বিশ্বদর্শন, যা প্রকৃতির ভারসাম্য (Ecological Balance) নিশ্চিত করার পথ নির্দেশ করে।
 
 
অথচ আজকের পরিবেশবিজ্ঞান এই ভারসাম্যই রক্ষার জন্য সর্বান্তকরণে চেষ্টা করে যাচ্ছে।
পবিত্র কোরআন ঘোষণা করেছে, মানুষ এই পৃথিবীর মালিক নয়, বরং প্রতিনিধি মাত্র। সুরা ফাতিরের ৩৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনিই তোমাদের পৃথিবীতে খলিফা করেছেন...’ খলিফা শব্দটি এসেছে ‘খিলাফত’ থেকে।
 
এর অর্থ হচ্ছে একজন দায়িত্বশীল তত্ত্বাবধায়ক, যিনি ব্যবহারে অতিরঞ্জন করবেন না, অপচয় করবেন না, ধ্বংস করবেন না। দেখুন, আজকের পরিবেশনীতির অন্যতম অধ্যায় Sustainable Development বা টেকসই উন্নয়ন ধারণার ভিত্তিও কিন্তু এটিই।
 
অপচয় ও সংযম
 
পানি ব্যবহারে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তুমি যদি প্রবহমান নদীর ধারে থাকো, তবু অজুতে পানি অপচয় করো না।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২৫)
 
অপচয় রোধ নিয়ে কোরআন বলেছে, ‘তোমরা খাও এবং পান করো, কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩১)
 
দেখুন, আজকের পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম মূলনীতি Zero Waste (শূন্য অপচয়)। আর ইসলাম এর ভিত্তি স্থাপন করেছে দেড় সহস্রাধিক বছর আগেই।
 
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান
 
কোরআন ঘোষণা করেছে : ‘পৃথিবীর প্রতিটি জীব এবং আকাশে উড়ন্ত প্রতিটি পাখিই তোমাদের মতো এক একটি জাতি।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৩৮)
 
এ আয়াতে মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীরাও এক একটি জাতি বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। যার ফলে এদেরও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই জীববৈচিত্র্য (Biodiversity)
 
 রক্ষা করা শুধু বিজ্ঞান নয়, ঈমানেরও দাবি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্টিন লিংস তাঁর গ্রন্থ ‘What is Sufism’-এ লেখেন :
 
‘In Islam, even a tree has its sanctity. It is part of the cosmic submission to God.
 
‘ইসলামে একটি গাছও পবিত্রতা রাখে। এটি আল্লাহর প্রতি সৃষ্টির সর্বজনীন আনুগত্যের অংশ।’ অর্থাৎ ইসলামের দৃষ্টিতে গাছ বা প্রকৃতির যেকোনো উপাদান নিছক বস্তু নয়, এটি একটি সৃষ্ট জীব, যার নিজের একটি মর্যাদা ও উদ্দেশ্য আছে। শুধু মানুষ নয়, প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান—বৃক্ষ, পাহাড়, নদী, এমনকি পশুপাখিও আল্লাহর প্রতি সার্বভৌম আনুগত্য করে চলেছে।
 
মানবিক অবহেলার পরিণতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়
 
ভূকম্পন, খরা বা অতিবৃষ্টির নেপথ্যে বড় একটি কারণ হলো মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। এ ক্ষেত্রে কোরআন সাবধান করে স্পষ্টভাবে বলেছে—‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলভাগ ও জলভাগে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, যাতে আল্লাহ তাদেরকে তাদের কিছু কাজের আস্বাদ দেবেন, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা : রুম, আয়াত : ৪১)
 
এই আয়াতের অর্থ অত্যন্ত গভীর। মানুষ যখন সীমা লঙ্ঘন করে, প্রকৃতি তখন প্রতিক্রিয়া জানায়। আজকের বন্যা, খরা, মহামারি—সবই একরকম প্রতিক্রিয়া মাত্র। কাজেই মানবসৃষ্ট দূষণ থেকে মুক্ত থাকার আহবান কেবল বিজ্ঞানের ভাষ্য নয়, কোরআনেরও আহবান।
 
পরিবেশ এক ‘আমানত’
 
ইসলামে পৃথিবী মানবজাতির প্রতি একটি মহান আমানত। আমরা এর প্রতি যত্নবান হবো কি না এটাই ঈমান ও বিবেকের পরীক্ষার মাপকাঠি। পরিবেশবাদ আজকের পৃথিবীতে এক জরুরি বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক আন্দোলন। অথচ কোরআন এটিকে বহু আগে চিহ্নিত করেছে এক নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে। আমরা যদি সত্যিকার মুসলিম হতে চাই, তবে আমাদের গাছ রোপণ করতে হবে, পানি সংরক্ষণ করতে হবে, প্রাণীর অধিকার দিতে হবে এবং প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে।
 
এই পৃথিবী আমাদের না, আমরা এই পৃথিবীর দায়িত্বপ্রাপ্ত রক্ষক মাত্র। মহান আল্লাহ আমাদের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
captcha