IQNA

সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ; যুগের এক প্রতিভা

9:35 - October 05, 2025
সংবাদ: 3478189
ইকনা- নিযাম মারদিনি, সিরীয় লেখক ও বিশ্লেষক, এক নিবন্ধে লিখেছেন— “সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ এমন একজন ব্যক্তি, যিনি কাউকে তাঁর নামে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করান না। তাঁর সম্পর্কে লেখা প্রশংসা বা গৌরবগাথা নয়; বরং এটি এক প্রতিরোধের প্রতীকী কর্ম, যা ন্যায়বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাকে পুনরুজ্জীবিত করে।”
ইকনা নিউজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আল-মায়াদিনে প্রকাশিত এই লেখায় নিযাম মারদিনি লিখেছেন: শহীদ সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ সম্পর্কে প্রথম শাহাদাত বার্ষিকীতে লেখা শুধুমাত্র আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়; বরং এটি এক ধরণের প্রতিরোধ ও আনুগত্য, যা তাঁর অনুপস্থিতির বেদনার মধ্যেও আমরা ধারণ করে চলেছি। এটি লেবাননের এক ঐতিহ্য—আনতুন সা’দাহর শাহাদাত থেকে শুরু করে সাইয়্যেদুল-শুহাদা হাসান নাসরুল্লাহর আরোহন পর্যন্ত।
ইতিহাস মূলত “মহান মানুষদের” প্রভাব দ্বারা গঠিত—অর্থাৎ, এমন ব্যক্তিবর্গ যারা তাদের স্বাভাবিক গুণাবলি, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, সাহসিকতা, নেতৃত্বগুণ ও সর্বোপরি শাহাদাতের মাধ্যমে ইতিহাসে নির্ণায়ক ভূমিকা রেখেছেন।
স্কটিশ দার্শনিক ও লেখক থমাস কারলাইল একবার বলেছিলেন: “বিশ্বের ইতিহাস আসলে মহান মানুষদের জীবনী ছাড়া আর কিছুই নয়।”
 “শাহাদাত” এমন এক ধারণা, যা লেবাননের সমাজের বিভিন্ন অংশকে যুক্ত করেছে এবং পরবর্তীতে প্রসারিত হয়ে সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহর মানবিক অভিজ্ঞতার প্রতিটি দিককে এক প্রতীকী অর্থে ধারণ করেছে।
শাহাদাতের দর্শন কেবল দুর্বল ও উদাসীনদের নিন্দা করে না—যারা আত্মসমর্পণকে বৈধতা দিয়েছে—বরং তাদের চিন্তা ও বক্তব্যকেও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে।
সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহর প্রথম শাহাদাত বার্ষিকী উদ্‌যাপন কোনও আনুগত্যের প্রতিযোগিতা নয়; বরং এটি এমন বহুমাত্রিক জাতীয় বয়ানের প্রয়োজন দাবি করে, যা ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠবে—কোনও প্রতীকী সুবিধা অর্জনের উপায় নয়।
নাসরুল্লাহ এমন একজন নেতা, যিনি কারও প্রশংসা বা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি চান না; বরং এমন মানুষ চান, যারা তাঁর কণ্ঠ শুনবে, তাঁর গল্প সৎভাবে বলবে, তাঁর অবস্থানের পক্ষে দাঁড়াবে—কোনও অর্থ, স্বীকৃতি বা প্রশংসার প্রত্যাশা ছাড়া। তাঁর আদর্শ আমাদের শেখায়, সত্যিকারের সংহতি দাবি করে অর্জন করা যায় না, এটি দান ও নিষ্ঠার মাধ্যমে প্রকাশ পায়; এবং আনুগত্য কেবল শ্লোগানে নয়, বরং অবস্থানে প্রতিফলিত হয়।
শহীদ নাসরুল্লাহর শাহাদাতের দিনে জনগণের উচ্চস্বরে কান্না ছিল তাদের বোধগম্য ও নৈতিক দায়িত্ববোধের প্রকাশ। তিনি লেবানন ও ফিলিস্তিনের বাইরে কোথাও শাহাদাত বরণ করেননি—বরং এই ভূখণ্ডের মধ্যেই, যা প্রমাণ করে তাঁর মিশন আমাদের ধারণার চেয়েও গভীর ও জটিল ছিল।
লেবানন ও আরব বিশ্বের মানুষকে এখন ন্যায্যতার সঙ্গে বিচার করতে হবে—যারা এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে তাদের পাশে, আর যারা নাসরুল্লাহর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ও বিদেশি দূতাবাসের কাছে মাথানত করেছে, তাদের প্রকাশ্যে নিন্দা করতে হবে।
সাইয়্যেদ নাসরুল্লাহ সম্পর্কে লেখা কোনও প্রশংসা নয়, বরং এটি এক প্রতিরোধের প্রতীক, যা ন্যায়বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাকে জাগ্রত করে। তাই আজকের দিনে বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব শুধু শহীদের বিষয়ে লেখা নয়, বরং মানবতা, অর্থ, ন্যায়বিচার ও অমর আশার বিষয়ে লেখা—যা কখনও নিঃশেষ হয় না।
শাহাদাতের মূল্য অনুধাবন এবং তার দায়বদ্ধতা পালন—শহীদদের প্রতি আনুগত্যেরই অংশ। এটি সমাজকে আত্মত্যাগের মানসিকতা শেখায়। লেবাননের চ্যালেঞ্জ ও আকাঙ্ক্ষা এখনও শেষ হয়নি; বরং বাস্তবতা প্রমাণ করছে, শত্রুর বর্বরতা ও তাদের দালালদের বেহায়াপনা দিন দিন বেড়েই চলছে। লেবানন টানা এক বছর ধরে প্রতিদিন ইসরাইলি হামলার মুখে টিকে আছে।
এই শত্রু এতটাই মূর্খ যে অহংকার ও উন্মত্ততার দুটি কাঠের লাঠির ভরসায় দাঁড়িয়ে আছে—একটি তার গর্ব, অন্যটি তার মারাত্মক অস্ত্র। কিন্তু আগুন একদিন সেই লাঠিগুলো পুড়িয়ে ফেলবে—বছর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্মে প্রতিরোধের এই যোদ্ধাদের হাতে। এই যুদ্ধ ভুলে যাওয়া যাবে না—এটি এক চলমান ফিলিস্তিনি, লেবাননি, সিরীয় ও ইয়েমেনি হলোকাস্ট, যা তলমুদপন্থীদের হাতে সংঘটিত।
প্রতিরোধের এই প্রজন্ম, যারা তাদের নেতার প্রতি বিশ্বাসী, আজকের মুহূর্তকে একটি মহাকাব্যে পরিণত করেছে যা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা প্রমাণ করছে—এটি এক অটল, প্রতিভাবান প্রজন্ম, যাদের মনোবল ভাঙা, অপমান করা বা দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
এটি কোনও শোকগাথা নয়, যে আমরা নিজেদের দুঃখ প্রশমিত করার জন্য লিখছি; বরং এটি এক দৈনন্দিন বাস্তবতা—যা আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। এই মুহূর্তগুলোই ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে, মৃত্যু, ক্ষুধা ও হত্যার ভিড়ে আশার এক চিহ্ন হয়ে।
এই বার্ষিকী এমন এক সময় এসেছে, যখন লেবানন (এবং ফিলিস্তিন) অভ্যন্তরীণ বিভেদের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রতিরোধ ও অস্ত্রের বিষয়ে একটি গভীর আলোচনা প্রয়োজন—বিশেষ করে বর্তমান বাস্তবতায়, যেখানে আরব সমাজে স্বাভাবিকীকরণ (normalization) চলমান, এবং লেবাননের ভেতরে কেউ কেউ তার প্রভাবে আক্রান্ত। লেবাননের কিছু রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী হয় শত্রুর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছে, অথবা গাজার গণহত্যা নিয়ে নীরব থেকেছে, কিংবা আরব অর্থনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে মুখ বন্ধ রেখেছে।
শেষে বলা যায়: শাহাদাত সাহস দিয়ে শুরু হয় না, যদিও তা সাহসের মাধ্যমেই অর্জিত হয়; এটি বীরত্বে শেষ হয় না, যদিও বীরত্ব ছাড়া তা সম্ভব নয়।
সাহস ও বীরত্বের মধ্যে যেমন জ্ঞানের সম্পর্ক আছে, তেমনি সাহস ও সচেতনতার মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, এবং সংস্কৃতি ও সচেতনতার মধ্যে আছে বিশ্বাসের বন্ধন। তাই শাহাদাত হচ্ছে সচেতন বীরত্ব এবং এক আদর্শে অবিচল বিশ্বাস, যা মানুষের অন্তরে জেগে ওঠে।
সাহস যদি বীরত্বে রূপ না নেয়, তবে তা কেবল বেপরোয়া দুঃসাহস। আর বীরত্ব সাহস ছাড়া অসম্ভব। শাহাদাতপূর্ণ সাহসিকতা সমাজে মর্যাদা ও মূল্যবোধের অনুভূতি জাগায়—যা সমাজকে আরও উত্তম জীবনের পথে পরিচালিত করে। 4308781#
 
captcha