
আল-কুদস আল-আরাবি সূত্রে জানা গেছে, বিশ্লেষক সামেহ আল-মাহারিক কাতারে ইসরাইলি হামলা ও দোহায় অনুষ্ঠিত আরব ও ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনকে ঘিরে লিখেছেন: আবুধাবি এই হামলার প্রতি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ দোহা সফরে গিয়ে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ-এর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মনে হচ্ছে, ইসরাইলের সঙ্গে আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে আমিরাতের আনুষ্ঠানিক অবস্থান একটি সংকটময় মুহূর্তে পৌঁছেছে। কারণ, ডানপন্থী ইসরাইলি রাজনীতির উগ্র আচরণ ঐতিহ্যগত মিত্রদেরও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। এ প্রেক্ষাপটে আমিরাতি ব্যবসায়ী খলাফ আল-হাবতুরের মন্তব্য—যেখানে তিনি ইসরাইলি বিমানের জন্য নো-ফ্লাই জোন দাবি করেছেন—তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
হাবতুর অতীতে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের উৎসাহী সমর্থক ছিলেন, যিনি ট্রাম্প আমলের শুরুতে চুক্তি স্বাক্ষরে ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর অবস্থানের পরিবর্তন এখন আমিরাতের অস্বস্তি প্রকাশ করছে, বিশেষত যখন পশ্চিম তীর দখলের দাবি বাড়ছে এবং গাজা উপত্যকাকে পুনরায় দখলের প্রচেষ্টা জোরদার হচ্ছে। এর ফলে আব্রাহাম চুক্তির মূল ভিত্তি—যেটি শান্তির দ্বার হিসেবে প্রচারিত হয়েছিল—ধসে পড়েছে।
চুক্তিটি ইসরাইলকে অর্থনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে রাজনৈতিক ছাড় দেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু বাস্তবে ইসরাইল দেখিয়েছে, তারা সব শান্তিচুক্তিকে নিজেদের স্বার্থে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে চায়, অংশীদার দেশের ক্ষতির প্রতি কোনো গুরুত্ব না দিয়েই।
দোহায় হামলা শুধু একটি তড়িঘড়ি পদক্ষেপ ছিল না; এটি ইসরাইলের আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও নির্দেশ করে। হিজবুল্লাহর হুমকি কমে যাওয়া, সিরিয়ায় ইরানের ভূমিকা সীমিত হওয়া এবং ভারত মহাসাগরীয় করিডোর প্রকল্পের অচলাবস্থা ইসরাইলকে নতুন দিক খুঁজতে বাধ্য করেছে। এর ফলে “ডেভিড করিডোর” বা অন্য কোনো নতুন ভৌগোলিক প্রকল্প, যা তথাকথিত “গ্রেটার ইসরাইল”-এর অংশ, এখনো ডানপন্থী রাজনীতির স্বপ্ন হিসেবে রয়ে গেছে।
রেড সি বা লোহিত সাগরও নতুন একটি বিকল্প হিসেবে উঠে আসছে, কারণ ইয়েমেনে আনসারুল্লাহর হুমকি প্রশমিত হয়েছে এবং মিশর-সুদান অভ্যন্তরীণ সংকটে জর্জরিত। সৌদি আরব এই নতুন হুমকির মুখে পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তির দিকে ঝুঁকছে, যা কার্যত ইঙ্গিত দেয়—ইরান আর উপসাগরের নিরাপত্তার জন্য প্রধান হুমকি নয়।
আব্রাহাম চুক্তির ভঙ্গুর ভিত্তি ছিল ইসরাইলি শ্রেষ্ঠত্বের দ্বিমুখী ধারণা উপেক্ষা করা: একদিকে ঔপনিবেশিক মানসিকতা, অন্যদিকে “নির্বাচিত জাতি” ধারণা। ফলে ইসরাইল কখনো আরবদের সমান মর্যাদা স্বীকার করে না। শান্তিচুক্তি হলেও ইসরাইল স্থায়ী ছাড় আশা করে, কিন্তু পাল্টা কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। কাতারের ওপর হামলা এই বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে তুলেছে, বিশেষত যখন নেতানিয়াহু কাতারকে ইসরাইলবিরোধী প্রচারণার উৎস হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন।
এখানে প্রশ্ন হলো, আসল লক্ষ্য ছিল হামাস, না কাতার? ইসরাইল আসলে হামাসের সঙ্গে সংঘর্ষ ও আঞ্চলিক ক্ষমতার পুনর্গঠনের মধ্যে পার্থক্য করছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত অবস্থান এবং উপসাগরকে কেবল একটি ভৌগোলিক এলাকা হিসেবে দেখার মানসিকতা এই অবস্থানকে আরও জটিল করেছে।
ইসরাইলি কৌশল এখন সরাসরি হুমকি থেকে শুরু করে উপসাগরীয় দেশগুলোকে চাপের মুখে রাখা পর্যন্ত বিস্তৃত। “ডেভিড করিডোর”—যা দক্ষিণ সিরিয়া থেকে শুরু হয়ে ইরাক হয়ে বিস্তৃত হতে চায়—এখন আর শুধু একটি নিরাপত্তা বলয় নয়; বরং এটি নতুন ভৌগোলিক বিস্তারের প্রকল্প।
এই পর্যায়ে সাবেক সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদ আল-ফয়সালের সেই মন্তব্য মনে পড়ছে, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ইসরাইলের নিরাপত্তা তত্ত্ব আফগানিস্তান থেকে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত। শান্তির দ্বার হিসেবে অর্থনীতি এখন আর কার্যকর নয়; ইসরাইল এখন এশিয়া ও নতুন ভূখণ্ডের দিকে নজর দিয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ও বহুমুখী যুদ্ধের প্রস্তুতির আলোচনা প্রমাণ করছে যে, ইসরাইল তাদের বিস্তৃত প্রকল্প বাস্তবায়নে “সন্ত্রাসবাদ” তত্ত্বকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যখন ইসরাইলের ছোট ভৌগোলিক পরিসর নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, আসলে তিনি ইসরাইলের ভবিষ্যৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আরও জমি ও প্রভাবের প্রয়োজনীয়তার দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন। এখন প্রয়োজন আরব দেশগুলোর সমন্বিত পদক্ষেপে এই প্রকল্পের খরচ এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, যা যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও অগ্রহণযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়। হাবতুরের প্রস্তাব হয়তো সেই বহুমাত্রিক চাপ প্রয়োগের সূচনা হতে পারে।
উপসাগরে এই হামলা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ধারণাকেই বদলে দিয়েছে। উপসাগরীয় দেশগুলোর প্রতিটি অবস্থানই এখন নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করা যায়। তবে এই হামলা এমন এক সময়ে ঘটছে, যখন আরব বিশ্ব প্রবল অস্থিরতায় রয়েছে। ইয়েমেন, সুদান, লিবিয়ার মতো সংকটগুলোর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি সম্ভব নয়। এই প্রেক্ষাপটে দোহা সম্মেলনও মূলত লক্ষ্য ঘোষণা ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। কিন্তু বিলম্বের মূল্য হবে ভয়াবহ। 4306249#