
কিন্তু উভয় কাফির দলের মধ্যে পারসিকরা ছিল অগ্নিপূজারি মুশরিক এবং রোমকরা ছিল নাসারা আহলে কিতাব। ফলে এরা ছিল মুসলিমদের অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কায় অবস্থানকালে পারসিকরা রোমকদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। হাফেজ ইবনে হাজার প্রমুখের উক্তি অনুযায়ী, তাদের এই যুদ্ধ শাম দেশের আজরুআত ও বুসরার মধ্যস্থলে সংঘটিত হয়।
এই যুদ্ধ চলাকালে মক্কার মুশরিকরা পারসিকদের বিজয় কামনা করত। কেননা শিরক ও প্রতিমাপূজায় তারা ছিল পারসিকদের সহযোগী। অন্যদিকে মুসলিমদের আন্তরিক বাসনা ছিল রোমকরা বিজয়ী হোক। কেননা ধর্ম ও মাজহাবের দিক দিয়ে তারা ইসলামের নিকটবর্তী ছিল।
রোমান বলতে মূলত সেই জাতিকে বোঝানো হয়, যারা ইতালীয় ভূমিতে বসবাস করত এবং রোম নগরকে কেন্দ্র করে মানব ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। তাদের শাসনের ছাপ আজও দৃশ্যমান—যেসব দেশ একসময় রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেসব স্থানে এখনো রোমানদের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাব লক্ষ করা যায়। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সংবিধানের অনেক উপাদানই রোমান ঐতিহ্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত। রোমানদের মূল উৎপত্তি পূর্ব ইউরোপে, যেখান থেকে তারা ধীরে ধীরে মধ্য ইউরোপে স্থানান্তরিত হয়ে ইতালীয় উপদ্বীপের উপকূলে বসতি স্থাপন করে। পরবর্তী সময়ে তারা ইতালির মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করে এবং সেখানে প্রতিষ্ঠা করে বিখ্যাত রোম শহর, যা পরে বিশ্বজুড়ে প্রভাব বিস্তার করে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রোমানরা একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন গড়ে তোলে। তারা প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে নিজেদের সমাজব্যবস্থাকে আরো সমৃদ্ধ করে। ধীরে ধীরে তারা শক্তি ও প্রভাব বিস্তার করতে করতে পুরো ইতালীয় উপদ্বীপকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর রোমান সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত হয়ে প্রাচীন বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চল দখল করে ফেলে। এর ফলে তারা ইতিহাসের প্রথম দিকের ঔপনিবেশিক জাতিগুলোর অন্যতম হিসেবে পরিগণিত হয়। রোমানদের উত্তরাধিকার আজও অমলিন; তাদের আইন, শাসনব্যবস্থা, স্থাপত্য ও সংস্কৃতি এখনো আধুনিক সভ্যতার ভিত্তির অংশ হিসেবে বিদ্যমান।
রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান
খ্রিস্টপূর্ব ৫০৯ সালে রোমান জনগণ রাজতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে এবং সেখান থেকেই রোমান সাম্রাজ্যের গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। তারা রাজনৈতিক ক্ষমতার নতুন এক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে, যার ভিত্তিতেই শুরু হয় তাদের ভৌগোলিক সম্প্রসারণ—প্রথমে ইতালির মধ্যেই, পরবর্তী সময়ে পুরো ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে। প্রথম রোমান প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর রোমানরা ইতালির বিভিন্ন ছোট উপজাতি ও শহর-রাষ্ট্রকে পরাধীন করে একীভূত করতে থাকে। এভাবেই তারা একটি সংগঠিত ও শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এরপর আসে দ্বিতীয় রোমান প্রজাতন্ত্র, যখন রোমানদের দৃষ্টি ইতালীয় ভূমির সীমানা ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে প্রসারিত হয়। তখন তাদের মুখোমুখি হতে হয় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম প্রধান শক্তি—কার্থেজ রাজ্য। শুরু হয় বিখ্যাত রোমান-কার্থাজিনীয় যুদ্ধ, যা ইতিহাসে পিউনিক যুদ্ধ নামে পরিচিত। দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষ শেষ পর্যন্ত রোমানদের গৌরবময় বিজয়ে পরিণত হয়। বিজয়ের পর রোমানরা ইউরোপের উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষত স্পেনের বৃহৎ অংশ দখল করে নেয় এবং সেখান থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত তাদের প্রভাব বিস্তার করে। এরপর তারা পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে গ্রীক অঞ্চলগুলো জয় করে এবং মেসিডোনিয়ান রাজত্বকে উত্খাত করে। এই ধারাবাহিক অভিযানে তারা ধীরে ধীরে লেভান্ট, ইউরোপের বৃহৎ অংশ এবং পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
রোমানদের পতন
তাদের এই বিস্ময়কর উত্থান একসময় ইতিহাসের এক অমোঘ নিয়ম অনুযায়ী পতনের দিকে গড়ায়। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক দুর্নীতি, প্রশাসনিক জটিলতা এবং বহিরাগত আক্রমণের কারণে একসময় মহাশক্তিশালী রোমান সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে, তবে তাদের সভ্যতার ছাপ আজও বিশ্বের রাজনীতি, আইন, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যে অম্লানভাবে বিদ্যমান। রোমান সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় ২৩৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে, যখন বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া বৃহৎ রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো সাম্রাজ্যকে গভীর সংকটে ফেলে দেয়। এই সময়ে রোমানরা নানা দিক থেকে বিপদের মুখোমুখি হতে শুরু করে। উত্তরের জার্মানিক উপজাতিদের অবিরাম আক্রমণে সাম্রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, এমনকি তারা রোমান ভূখণ্ডের কিছু অংশ দখল করতেও সক্ষম হয়। অন্যদিকে পূর্বে পারস্য সাম্রাজ্য আবারও শক্তি ফিরে পায় এবং ধীরে ধীরে মেসোপটেমিয়া, আর্মেনিয়া ও সিরিয়া অঞ্চলগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। ফলে রোমান সাম্রাজ্যের প্রভাব ক্রমে ক্ষয় হতে থাকে। দীর্ঘদিনের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা সাম্রাজ্যকে আরো দুর্বল করে তোলে। অবশেষে এই অস্থিরতার পরিণতিতে সাম্রাজ্যকে পূর্ব রোমান ও পশ্চিম রোমান—এই দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়, যা ছিল রোমান গৌরবের প্রকৃত অবসানের সূচনা। ৩২৪ খ্রিস্টাব্দে আদ্রিয়ানোপলের যুদ্ধে বিজয়ের পর সম্রাট কনস্টানটাইন মহান (ঈড়হংঃধহঃরহব ঃযব ত্বেধঃ) উভয় অংশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে একক শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি সাম্রাজ্যকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কার চালু করেন। তাঁর অন্যতম ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ছিল খ্রিস্টানদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা প্রদান, সাম্রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং নতুন রাজধানী কনস্টানটিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) প্রতিষ্ঠা করা। তবে কনস্টানটাইনের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরিরা দুর্বল ও অদক্ষ প্রমাণিত হয়। তারা ক্রমাগত পারস্যের সঙ্গে যুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে উদীয়মান মুসলিম শক্তির মোকাবেলায় ব্যস্ত থাকে। অবশেষে ১৫শ শতাব্দীতে কনস্টানটিনোপল তুর্কিদের হাতে পতিত হয় এবং এর মধ্য দিয়েই রোমান সাম্রাজ্যের চিরন্তন অধ্যায়ের অবসান ঘটে।
রোমান সভ্যতা শুধু যুদ্ধ ও শাসনেই নয়, শিল্প, স্থাপত্য, আইন এবং উৎসবমুখর জীবনধারার জন্যও বিখ্যাত ছিল। তাদের সংস্কৃতি এতটাই জীবন্ত ও আকর্ষণীয় ছিল যে আজও অনেকেই ভাবে, ‘যদি রোমানদের যুগে বেঁচে থাকতে পারতাম!’