
ইকনা সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আল-মায়াদিনের সূত্রে জানা যায়: নেতানিয়াহুর দপ্তর ঘোষণা করেছে যে, ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দিমুক্তি চুক্তি অনুমোদন করেছে।
মন্ত্রিসভার সম্মতির পর গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর পর্যায়ে প্রবেশ করেছে এবং ইসরায়েলি হামলা বন্ধ হয়েছে।
উল্লেখ্য, এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি গতকাল (১৭ মেহর) মিশরের শারমুশেখ শহরে হামাস ও ইসরায়েলি সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়।
হামাসের প্রতিনিধি খালিল আল-হাইয়ার বিশেষ কৃতজ্ঞতা
গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের পর হামাসের আলোচক প্রতিনিধি পরিষদের প্রধান খালিল আল-হাইয়া দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন: “আমাদের বিশেষ কৃতজ্ঞতা ইয়েমেন, লেবানন, ইরাক ও ইরানের ভাইদের প্রতি—যারা রক্ত ও সংগ্রামে আমাদের পাশে ছিলেন—এবং বিশ্বের সকল স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতি, যারা আমাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন।”
তিনি বলেন, গাজার জনগণ ও প্রতিরোধযোদ্ধারা অভূতপূর্ব অপরাধের মুখেও দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং আলোচনার টেবিলেও সেই একই প্রতিরোধের চেতনায় শত্রুর লক্ষ্য ব্যর্থ করে দিয়েছেন।
আল-হাইয়া আরও বলেন: “বিশ্ব আজ গাজার জনগণের ত্যাগ, ধৈর্য ও অবিচলতার সামনে বিস্মিত। তারা এমন এক যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে, যার তুলনা ইতিহাসে নেই। হত্যাযজ্ঞ, গৃহহানি ও দুর্ভিক্ষের মাঝেও গাজার মানুষ পর্বতের মতো অটল থেকেছে।”
তিনি ৭ অক্টোবরের বার্ষিকী স্মরণ করে শহীদ নেতাদের শ্রদ্ধা জানান: “আমরা স্মরণ করছি আমাদের শহীদ নেতৃবৃন্দ—ইসমাইল হানিয়া, সালাহ আল-আরুরি, ইয়াহিয়া সিনওয়ার এবং মোহাম্মদ আদ-দেইফ—যারা ‘তোফানুল আকসা’ অভিযানের শিখা প্রজ্বলিত করেছিলেন।”
আল-হাইয়া আরও যোগ করেন যে, প্রতিরোধের যোদ্ধারা শত্রুর সকল ষড়যন্ত্র—অবরোধ, দুর্ভিক্ষ, অরাজকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা—ব্যর্থ করে দিয়েছে।
“আপনারা যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন ছিলেন, আমরা আলোচনার ময়দানেও সেই দৃঢ়তার সঙ্গে ছিলাম,” —তিনি বলেন।
তিনি জানান, ইসরায়েলি পক্ষ ধীরগতি, হত্যা ও মধ্যস্থতার ব্যর্থ প্রচেষ্টা দ্বারা একাধিকবার আলোচনার প্রক্রিয়া বিঘ্নিত করেছে। তবুও হামাস সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছে যুদ্ধ থামাতে এবং নিরপরাধ রক্তপাত রোধে।
আল-হাইয়া বলেন, হামাস যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির প্রস্তাবের জবাবে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থরক্ষাকারী ও রক্তপাত বন্ধে কার্যকর প্রতিক্রিয়া দিয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী— যুদ্ধ ও হামলা সমাপ্ত হবে এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতি শুরু হবে; রাফাহ সীমান্ত খুলে দেওয়া হবে এবং মানবিক সহায়তা প্রবেশ করবে এবং ২৫০ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি বন্দি এবং গাজা উপত্যকার ১,৭০০ জন আটককৃত নাগরিক মুক্তি পাবেন।
আল-হাইয়া জানান, মধ্যস্থ দেশসমূহ ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে গ্যারান্টি পাওয়া গেছে যে, যুদ্ধ সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়েছে।
তিনি মিশর, কাতার ও তুরস্কের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন:
“ইয়েমেন, লেবানন, ইরাক ও ইরানের মুসলিম জাতির প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ—তারা আমাদের সঙ্গে রক্ত ও সংগ্রাম ভাগাভাগি করেছেন। বিশ্বের সকল স্বাধীন মানুষকেও ধন্যবাদ, যারা ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছেন।”
তিনি আরও বলেন, গাজা গত দুই বছর ধরে একাই অলৌকিকতা সৃষ্টি করেছে, বিশ্বের মুক্ত মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং ক্ষতগুলোতে মলম দিয়েছে।
“গাজা আজ আবার প্রমাণ করেছে—তার ভূমি শত্রুর জন্য হারাম, তার মানুষ অদম্য, এবং তারা কখনো প্রতারণায় পরাজিত হবে না।”
গাজা থেকে দখলদার বাহিনীর প্রত্যাহার শুরু
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি সেনারা গাজার কিছু অঞ্চল থেকে ক্রমিকভাবে প্রত্যাহার শুরু করেছে।
নাগরিকরা ইতোমধ্যে আন-নাসর, আত-তুফাহ ও আস-সাফতাবি এলাকায় ফিরে যেতে শুরু করেছেন।
ইসরায়েলের চ্যানেল ১২ টিভি জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ৭ম ডিভিশন গাজা উপত্যকা থেকে সরে আসা শুরু করেছে।
রেডিও ইসরায়েলও জানিয়েছে, সেনারা খুব শিগগিরই সম্মত “হলুদ রেখা” পর্যন্ত পিছিয়ে যাবে।
তবে এর আগে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে পূর্ব গাজায় হেলিকপ্টার ও আর্টিলারি হামলা চালায় এবং আন-নাসর এলাকায় একটি বাড়িতে বিমান হামলা চালায়।
ইসরায়েলি নৌবাহিনীর নৌকা থেকেও গাজার কেন্দ্রস্থল রাশিদ সড়কে গোলাবর্ষণ করা হয়।
জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিক্রিয়া
মিডল ইস্ট নিউজ অনুযায়ী, জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস বলেছেন:
“গাজার যুদ্ধ বিপুল মানবিক ক্ষতি ডেকে এনেছে; এই যুদ্ধবিরতি মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির সূচনা হওয়া উচিত।”
তিনি ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান বাস্তবায়নের আহ্বান জানান।
গুতেরেস বলেন, জাতিসংঘ এবং তার অংশীদাররা তাৎক্ষণিক মানবিক সহায়তা, খাদ্য, পানি ও আশ্রয় প্রদানের জন্য প্রস্তুত।
তিনি আরও বলেন: “আমরা শুধু রক্তপাত থামাতে চাই না; আমরা নিরাপত্তাও চাই। এই মুহূর্তের জন্য আমরা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছি।”
মহাসচিব সকল পক্ষকে চুক্তির প্রতি সম্মান ও সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে মধ্যস্থ দেশগুলোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন।
হামাসের প্রতিক্রিয়া: যুদ্ধবিরতি ব্যাহত করতে ইসরায়েলের নতুন হামলা
ফিলিস্তিনি ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস এক বিবৃতিতে জানায় যে, গাজার পশ্চিমাঞ্চলে ঘাবুন পরিবারবাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলা, যা ৭০ জনেরও বেশি নিরীহ নাগরিকের শাহাদাত ও আহত হওয়ার কারণ হয়, তা একটি বর্বর ও নতুন যুদ্ধাপরাধ।
ফিলিস্তিন ইনফরমেশন সেন্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামাস বলেছে—
এই হামলা নেতানিয়াহু সরকারের উদ্দেশ্যমূলক চেষ্টা, যাতে মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা বিফল করে যুদ্ধবিরতি চুক্তির বাস্তবায়ন বিলম্বিত করা যায়।
হামাস মধ্যস্থ দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়:
“এই ভয়াবহ অপরাধের দায়ভার গ্রহণ করুন, নিন্দা জানান এবং অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করুন—যাতে শিশু ও নিরীহ নাগরিকদের ওপর হামলা বন্ধ হয়।”
গাজার সিভিল ডিফেন্স বৃহস্পতিবার রাতে জানায়, আস-সাবরা মহল্লায় এক চারতলা ভবনে বিমান হামলায় ৪ জন শহীদ ও ৪০ জন নিখোঁজ হয়েছেন।
ইসরায়েলি সামরিক সূত্রের বরাতে কিছু গণমাধ্যম জানিয়েছে—এই হামলার লক্ষ্য ছিল হামাসের দুই সদস্যকে হত্যা করা।
গাজায় যুদ্ধবিরতির তত্ত্বাবধানে ২০০ মার্কিন সেনা প্রেরণ
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র গাজায় যুদ্ধবিরতির বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণে ২০০ মার্কিন সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রয়টার্স জানায়, এই সেনারা মিশর, কাতার ও তুরস্কের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি যৌথ বিশেষ বাহিনীর অংশ হবে, যার লক্ষ্য গাজায় স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং মানবিক সহায়তার প্রবেশ সহজতর করা। 4309839#