IQNA

নেপালে ইসলাম ও মুসলমান

13:37 - September 18, 2025
সংবাদ: 3478089
ইকনা- পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল। হিন্দু রাষ্ট্র হলেও নেপালে ইসলামের কমবেশি চর্চা ও বিস্তার ছিল সব সময়। হিমালয়কন্যা নেপাল এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত। স্বাধীন নেপালের আয়তন এক লাখ ৪৭ হাজার ১৮৮ বর্গকিলোমিটার।
নেপালের ভৌগোলিক সীমারেখা হচ্ছে দেশটির উত্তরে চীনের তিব্বত, পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণে ভারত অবস্থিত। দেশটির পূর্বে ভারত ছাড়াও ভুটানের অবস্থান আছে। ২০২৩ সালের আদমশুমারি অনুসারে নেপালের জনসংখ্যা দুই কোটি ৯৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৮ জন। জনসংখ্যার ৮১.১৯ শতাংশ হিন্দু।
 
আর মুসলিম জনসংখ্যা ১৪ লাখ ৬০ হাজার। শতকরা হিসেবে এটি ৫.০৯ শতাংশ।
নেপালে ইসলামের আগমন
 
হিমালয়ের দেশ নেপালে কয়েকটি পর্যায়ে ইসলামের আগমন ঘটে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫ শতকে কাশ্মীরি মুসলিম ব্যবসায়ীরা প্রথম নেপালে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে হাজির হন।
 
পরবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানরা নানা কারণে নেপালে গমন করে। তারা সেখানে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে বসবাস করছে। এসব মুসলমানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে নেপালে ইসলামের বিস্তার ঘটে। কিছু কিছু ঐতিহাসিকের মতে, মোগল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ সাল) নেপালের কিছু অংশে মুসলিম শাসনের প্রভাব পড়েছিল। পঞ্চদশ শতকের শেষার্ধে এবং ষোড়শ শতকের শুরুতে রাজার শাসনামলে কাঠমাণ্ডু উপত্যকায় কাশ্মীরি মুসলিম বণিকদের আগমন ঘটে।
 
তারা কাশ্মীরের বিখ্যাত কার্পেট ও উল বিক্রির উদ্দেশ্যে তিব্বত হয়ে নেপালে আগমন করে। তাদের মাধ্যমেও নেপালে ইসলামের বিকাশ ঘটে।
এদিকে ১৮৫৭ সালে ভারতে সিপাহি বিদ্রোহের পর নেপালের তেরাই অঞ্চলে বিপুলসংখ্যক মুসলিমের আগমন ঘটে। এসব মুসলমানের বেশির ভাগ ছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও কৃষিজীবী। তখন নেপালের হিন্দু জমিদাররা কৃষিকাজ করার জন্য এসব মুসলমানকে কাজে নিয়োগ করে। ফলে অভিবাসী মুসলমানদের কদর বেড়ে যায়। পাশাপাশি শাসক শ্রেণিও বেশি রাজস্বের আশায় অভিবাসনকে মেনে নেয়। ফলে নেপালে বিপুলসংখ্যক মুসলমানের আগমন ঘটে। তারা নেপালে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে সেখানে ইসলাম ও মুসলমানের বিস্তর বিস্তার ঘটে।
 
এদিকে ১৯৫০ সালে চীন তিব্বত দখল করে নেয়। এ সময় মুসলমানরা দেশটির তিব্বতে ভীষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ফলে একদল মুসলিম নিরাপত্তা ও ধর্ম পালনের আশায় নেপালে হিজরত করে। এখানে তারা স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করে। এর আগে ১৮৫৩ সালে নেপাল কোড চালু হলে মুসলমানদের নিম্ন শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা প্রদান করা হয়। ফলে হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় মুসলমানরা সাধারণ জনগণ হিসেবে বসবাস করার সুযোগ লাভ করে।
 
নেপালে যেসব মুসলমান বাস করে আঞ্চলিক বিবেচনায় তাদের চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়—ভারতীয়, তিব্বতি, কাশ্মীরি ও নেপালি। নেপালের মুসলিমদের আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়—১. তেরাই মুসলিম ও ২. পাহাড়ি মুসলিম।
 
নেপালে মুসলমানদের বর্তমান হাল-হকিকত
 
নেপাল একটি বহু ধর্মীয় দেশ। এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে। নেপালের সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকৃত। ফলে দেশটিতে মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও অন্যান্য ধর্মীয় স্থান আছে, যা সহাবস্থানের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কেউ কারো সঙ্গে বিরোধ নেই। ফলে হিন্দু রাষ্ট্র নেপালে ইসলামের প্রচার ও প্রসার অনেকটা সহজ ও নিরাপদ। তবে নেপালের মুসলিম নারীরা শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। নেপালে নারী শিক্ষার হার যেখানে ৫৫ শতাংশ, সেখানে মুসলিম নারীশিক্ষার হার মাত্র ২৬ শতাংশ। আরেকটি সমস্যা নেপালের মুসলিম নারীদের জন্য বিব্রতকর। তারা সব ধর্মীয় কর্ম পালন করতে পারলেও হিজাব পরা বা পর্দা করা নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়ে। অনেকে হিজাব পরাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখে থাকে।
 
এরপরও বলা যায়, নেপালে মুসলমানরা বেশ স্বাধীনতা ভোগ করছে। নেপালের গণতান্ত্রিক সরকার মুসলমানদের সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকার দেশের মসজিদ ও মাদরাসার উন্নতির জন্য বেশ সহানুভূতিশীল। নেপালে ২০০৭ সালে প্রথম মাদরাসা বোর্ড গঠিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে নেপাল সরকার দুই হাজার মাদরাসাকে তালিকাভুক্ত করেছে। নেপালে বর্তমানে প্রায় চার হাজার মাদরাসা ও শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। আর মসজিদ আছে মোট ৪৩০টি।
 
নেপালের প্রায় সব জেলায় মুসলিম জনগণের বাস। প্রতিটি জেলায় প্রায় ১০ থেকে ২৫ হাজার মুসলমান বাস করে। তারা সেখানে মসজিদ-মাদরাসা তৈরি করে স্বাধীনভাবে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড ও উৎসব পালন করতে পারছে।
 
লেখক : ইকবাল কবীর মোহন, শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও সিনিয়র ইসলামী ব্যাংকার
captcha