IQNA

সুলতান দ্বিতীয় আবদুল মজিদের শিল্পপ্রতিভা

20:49 - November 11, 2022
সংবাদ: 3472802
তেহরান (ইকনা): উসমানীয় সালতানাতের শেষ শাসক সুলতান দ্বিতীয় আবদুল মজিদ। তাঁকে বলা হয় মুসলিম বিশ্বের শেষ খলিফা। রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সাক্ষী সুলতান দ্বিতীয় আবদুল মজিদ শিল্পানুরাগী। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি ছিলেন একজন দক্ষ চিত্রশিল্পী।
তুর্কি শিল্পকলার ইতিহাসে সেরা চিত্রশিল্পীদেরও একজন তিনি। বহুরৈখিক ও বৈচিত্র্যময় সব ছবির স্রষ্টা যুবরাজ আবদুল মজিদ ছিলেন তুর্কি জাগরণের অন্যতম প্রাণপুরুষ। ১৯২৪ সালে তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রবর্তকরা শিল্পানুরাগী সুলতানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তারা চেয়েছিল তাঁকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেবে। কিন্তু সুলতানের শিল্পসত্তা তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে শিল্পানুরাগীদের কাছে।
সুলতান দ্বিতীয় আবদুল মজিদ ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে ইস্তাম্বুলের বেইলারবেই প্রসাদে জন্মগ্রহণ করেন। নানাবিদ সংকটে জর্জরিত উসমানীয় রাজপরিবারের আবাসস্থল এই প্রাসাদকে তুলনা করা হতো সোনার খাঁচার সঙ্গে। সালতানাতের গভীর ক্ষতগুলো এবং তুর্কি সমাজের অস্থিরতা শিশু আবদুল মজিদের দৃষ্টি রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে ফিরিয়ে শিল্প ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় আবদ্ধ করেছিল। ইস্তাম্বুলের ইলদিজ প্রসাদে স্থাপিত রাজপরিবারের সদস্য ও অভিজাত শিশুদের বিশেষায়িত স্কুলে দ্বিতীয় আবদুল মজিদ শিক্ষা গ্রহণ করেন। এই স্কুলে তিনি তুর্কি ও ফরাসি শিক্ষকদের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের গতিপথ নির্ধারণে এই স্কুলের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
 
অন্যান্য যুবরাজের তুলনায় আবদুল মজিদের জন্য সুলতান হওয়ার স্বপ্ন ছিল প্রায় অসম্ভব। তিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকারীদের ক্রমধারায় নিচের দিকে ছিলেন। রাজনৈতিক এই হতাশাই তাকে শিল্প ও সংগীত এবং রেড ক্রিসেন্টের মতো সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় করে তোলে। মূলত উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে উসমানীয় প্রাসাদে চিত্রকলাসহ পশ্চিমা শিল্পের চর্চা বাড়ে। সুলতান দ্বিতীয় আবদুল মজিদের পিতা আবদুল আজিজও একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন। তিনি তুরস্কের প্রথম চিত্রাঙ্কন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং তুর্কি শিক্ষার্থীদের শিল্পকলার পাঠ নিতে ইউরোপে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
 
সুলতান দ্বিতীয় আবদুল মজিদ যদিও ইস্তাম্বুলে প্রতিপালিত হন, তবে তিনি ইউরোপীয় রীতি-নীতিতেও অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মিলনস্থল। যদিও তিনি ধর্মীয় ও তুর্কি রীতি-নীতি অনুসারে জীবনযাপন করেছেন, তবে তিনি পশ্চিমের ব্যাপারে ছিলেন উদার। অবশ্য সমালোচকরা বলেন, সুলতান আবদুল মজিদ ছিলেন তুর্কি সংস্কৃতির প্রতি অভিজাত তুর্কি পরিবারগুলোর আস্থাহীনতার উত্কৃষ্ট উদাহরণ। তবে অনুরাগীরা তাঁকে যুগসচেতন ব্যক্তি বলেই আখ্যা দেয়।
 
সুলতান দ্বিতীয় আবদুল মজিদের শিল্পকর্মগুলো বৈচিত্র্যময়। একদিকে তাতে যেমন স্থান পেয়েছে ধর্মীয় অনুষঙ্গগুলো, তেমনি তাতে স্থান পেয়েছে মানুষ ও জীবজন্তুর প্রকৃতি, যা ইসলামে নিষিদ্ধ। তিনি একই সঙ্গে চিত্রশিল্পী ও ‘খাত্তাত’ তথা ইসলামী ক্যালিগ্রাফার ছিলেন। তিনি ছিলেন নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ, তবে পশ্চিমা শিল্পকলার অনুরাগী। তুর্কি চিত্রশিল্পের জগতে সাকার আহমেদ পাশা, উসমান হামিদি বে ও সোলাইমান সায়িদের পরই তাঁর স্থান বলে মনে করা হয়। ফটোগ্রাফির প্রতিও তার বিশেষ অনুরাগ ছিল। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের জীবনঘনিষ্ঠ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ছবি তুলেছেন। হায়দরাবাদের শেষ নিজাম উসমান আলী খানের ছেলের সঙ্গে তাঁর এক মেয়ের বিয়ে হয়।
 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সুলতান দ্বিতীয় আবদুল মজিদকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে এবং তিনি ১৯৪৪ সালে ইন্তেকাল করেন। সুলতানের পরিবার ইস্তাম্বুলে তাকে সমাহিত করার আবেদন করে এবং ১০ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে। কিন্তু তৎকালীন তুর্কি সরকার তা প্রত্যাখ্যান করায় তাকে মদিনার জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়।
 
কিছুদিন আগে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল মজিদের চিত্রকর্ম নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল তুরস্কের সাকিপ সাবাঞ্চি মিউজিয়াম। ‘আবদুল মজিদ আফেন্দি : যুবরাজের অসাধারণ জগৎ’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি ২০ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে ২ জুলাই ২০২২ পর্যন্ত চলে। এতে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল মজিদের আঁকা ৬০টি ছবি ও তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৩০০ নথিপত্র প্রদর্শন করা হয়। ছবিগুলোর মধ্যে ১৪টি পারিবারিক এবং ১৭টি সরকারি সংগ্রহশালা থেকে নেওয়া হয়। বাকি চিত্রকর্মগুলো ব্যক্তিগত সংগ্রহ ও বেসরকারি জাদুঘর থেকে আনা হয়। একই জাদুঘর চলতি বছর ‘প্রিন্স আবদুল মজিদ আফেন্দি অ্যান্ড আর্ট অব ক্যালিগ্রাফি’ শীর্ষক পৃথক প্রদর্শনীর আয়োজন করে, যাতে সুলতানের করা ১৬টি ক্যালিগ্রাফি স্থান পায়।
তথ্যসূত্র : মিডলইস্ট আই, ডেইলি সাবাহ ও টিআরটি ওয়ার্ল্ড
captcha