
এ দিন অর্থাৎ ৬১ হিজরীর ১০ মুহররম তাঁকে ৭২ জন সঙ্গী সাথী সহ কারবালায় অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে
শহীদ করে পাপিষ্ঠ কাফির ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনী । মযলূম ইমামের এবং তাঁর সকল শহীদ সঙ্গীসাথীদের মাথা কর্তন করে তাঁদের পবিত্র দেহের উপর অশ্ব চালিয়ে সেগুলো পিষ্ট ও পদদলিত করে ঐ পাপিষ্ঠ নরকের কীট ইয়াযীদীরা । আজ মহানবী ( সা:) , তাঁর পবিত্র আহলুল বাইত (আ:) এবং মুসলমানদের মুসীবৎ , শোক ও মাতমের দিন । হযরত জিবরাঈল ( আ :) পাপিষ্ঠ পথভ্রষ্ট নরাধম উম্মতের হাতে কারবালায় ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের সংবাদ দিলে রাসূলুল্লাহ ( সা:) , হযরত আলী (আ:) ও হযরত ফাতিমা যাহরা ( আ:) কেঁদেছিলেন ; শুধু তাই নয় শাহাদাতের দিন ( ৬১ হিজরীর ১০ মুহররম ) যে সময় ইমাম হুসাইনকে ( আ:) শহীদ করা হচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা:) নিজে কারবালায় উপস্থিত ছিলেন ; তাঁর চুল ও দাড়ি মুবারক ছিল এলোমেলো ও ধূলাবালি মাখানো এবং একটি কাঁচের শিশিতে ( ক্বারূরাহ ) নিজ হাতে ইমাম হুসাইন ( আ:) ও তাঁর সঙ্গী সাথীদের রক্ত সংগ্রহ করেছেন আল্লাহ পাকের দরবারে ঐ সব জঘন্য পাপিষ্ঠ কাতিল ও ঘাতকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করার জন্য ।
সহীহ তিরমিযী , তাহযীবুত তাহযীব ও উসদুল গাবায় সালমা থেকে বর্ণিত : তিনি ( সালমা ) বলেন : আমি হযরত উম্মে সালামার (নবীপত্নি উম্মুল মু'মিনীন) ( রা:) কাছে প্রবেশ করি ঐ অবস্থায় যে তখন তিনি কাঁদছিলেন । আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম : আপনি কী কারণে কাঁদছেন ? তখন তিনি বললেন : আমি ( স্বপ্নে ) মহানবীকে ( সা :) তাঁর মাথায় ও দাঁড়ি মাটি মাখা অবস্থায় দেখে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম : " হে রাসূলুল্লাহ , আপনার এ অবস্থা কেন ? " তিনি ( সা:) বললেন : " আমি এই কিছু ক্ষণ আগে হুসাইনের শাহাদাত বরণ প্রত্যক্ষ করেছি ।"
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন : আমি দিনের বেলায় স্বপ্নে মহানবীকে ( সা:) দেখলাম যে তাঁর চুল ও দাড়ি মুবারক এলোমেলো ও ধূলাবালি মাখানো এবং তাঁর হাতে রয়েছে রক্ত দিয়ে
পূর্ণ একটি কাঁচের শিশি । আমি তাঁকে বললাম : " হে রাসূলুল্লাহ , আপনার জন্য আমার পিতা মাতা উৎসর্গ হোক ; এটা কী ? " তিনি বললেন : এটা হুসাইন ও তাঁর সঙ্গী সাথীদের রক্ত । আজ থেকে আমি এই রক্ত সংগ্রহ করেই যাচ্ছি । " অত:পর ইবনে আব্বাস ( রা :) দিনটা হিসাব করে দেখলেন যে ঐ দিনই তিনি ( হুসাইন ) শহীদ হয়েছেন । ( দ্র : তাহযীবুত তাহযীব ,
আল - ইস্তিআব , উসদুল গাবাহ , আল বিদিয়াহ ওয়ান নিহায়াহ , তারীখুল খামীস )
প্রতিষ্ঠিত,সহীহ ও নির্ভরযোগ্য এ দুই হাদীস থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে যায়:
১.কারবালার মরু প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর আসহাবের (সংগী সাথীদের) শাহাদাত বরণ কালে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) উপস্থিত ছিলেন এবং ইয়াযীদের সেনাবাহিনী কর্তৃক তাঁদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা ও কতল করা প্রত্যক্ষ দর্শন করেছেন।
২. হুযূরে পাক (সা.) কারবালায় ইমাম হুসাইন , তাঁর সংগী সাথী এবং নবী পরিবারের (আহলুল বাইত) ওপর ইয়াযীদ ও তার সাঙ্গ পাঙ্গগণ কর্তৃক কৃত অন্যায়, অবিচার ও যুলুমের সাক্ষী।
৩.যেমন মহানবী (সা.) ইমাম হুসাইনের (আ.) শাহাদাত বরণের বহু আগেই (৫৭ বছর আগে) নিজ জীবদ্দশায় কান্নাকাটি ও শোক প্রকাশ করেছেন ঠিক তেমনি তিনি মৃত্যুর পর বারযাখ জগতেও ইমাম হুসাইন (আ) ও তাঁর সংগী সাথীদের শাহাদাত বরণের দিন অর্থাৎ ১০ মুহররম কারবালায় শোক প্রকাশ করেছেন যার প্রমাণ হলো যে স্বপ্নে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ও হযরত উম্মে সালামা (রা.) তাঁর (সা.) চুল ও দাড়ি মুবারক এলোমেলো এবং ধুলোবালি ও মাটি মাখা অবস্থায় প্রত্যক্ষ করেছিলেন যা হচ্ছে শোক প্রকাশ ও মাতমের চিহ্ন ও প্রতীক। অতএব কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ) ও তাঁর সংগী সাথীদের শাহাদাত উপলক্ষে শোক ও দু:খ প্রকাশ এবং মাতম ও কান্নাকাটি আসলে রাসূলুল্লাহর (সা.) সুন্নতের অনুসরণ এবং তা শিরক,বিদ'আত ও হারাম নয়। বরং ইমাম হুসাইন (আ) ও তাঁর শহীদ সংগী সাথীদের শাহাদাতের জন্য মাতম এবং শোক-দু:খ প্রকাশের বিরোধিতা ও বাধাদান করাই হচ্ছে মহানবীর (সাঃ) সুন্নত ও সিরাত-ই মুস্তাকীম হতে পূর্ণ বিচ্যুতি ও পথভ্রষ্টতা এবং তা হচ্ছে পাপিষ্ঠ খবীস বিষবৃক্ষ বনী উমাইয়ারই রীতি নীতি,প্রথা ও সুন্নত।
৪., মহানবী (সা.) কর্তৃক শিশিতে মযলূম শহীদ ইমাম হুসাইন ও তাঁর সংগী সাথীদের শাহাদাতের রক্ত সংগ্রহ থেকে প্রতীয়মান হয়ে যায় যে মহানবী (সা) হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কিয়ামত দিবসে আল্লাহর দরবারে বিচার দিবেন এবং তারা ( হত্যাকারীরা) এ জঘন্য অন্যায়ের জন্য আযাব প্রাপ্ত হবে এবং জাহান্নামে যাবে।
৫. ইয়াযীদ ও তাঁর অনুসারীরা ইমাম হুসাইনকে (আ.) হত্যা করে মহানবী (সা),হযরত আলী (আ.),হযরত ফাতিমা (আ.),ইমাম হাসান এবং সকল নবী-রাসূল , ফেরেশতা, পূণ্যবান ব্যক্তি তথা সমগ্র সৃষ্টিজগতকে ব্যথা ও দু:খ দিয়েছে এবং যারা রাসূল ও তার আহলুল বাইত কে দু:খ দেয় তাঁরা মহান আল্লাহর লানত ও গযবের পাত্র ও উপযুক্ত।
৬. আমাদের উচিত ও করণীয় হচ্ছে যে মহানবীকে (সা.) অনুসরণ করে মুহররম ও সফর মাসে কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ) ও তাঁর সংগী সাথীদের শাহাদাতের জন্য মাতম,আযাদারী ও শোক প্রকাশ করা।
৭. মহানবী হায়াতুন্নবী অর্থাৎ জীবিত এবং তিনি এ পৃথিবীতে আসতে পারেন যার প্রমাণ হচ্ছে আশুরার দিন ১০ মুহররম ৬১ হিজরী সালে কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ) ও তাঁর সংগী সাথীদের শাহাদাত বরণ কালে সেখানে তাঁর (সা.) উপস্থিতি ও শোক প্রকাশ। তাই যারা বলে যে মহানবী মৃত তারা স্পষ্ট পথভ্রষ্টতা ও গোমরাহীতে লিপ্ত রয়েছে।
অতএব মহান আল্লাহর অভিশাপ ( লানত ) ইমাম হুসাইনের (আ:) ঘাতক ও তাঁর শহীদ সঙ্গীসাথীদের হত্যাকারীদের উপর ।
اَللّٰهُمَّ الْعَنْ قَتَلَةَ الْحُسَيْنِ عَلَيْهِ السَّلَامُ
( আল্লাহুম্মাল্'আন্ ক্বাতালাল হুসাইন আলাইহিস সালাম )।
হে আল্লাহ পাক , ইমাম হুসাইনের ( আ:) ঘাতক হত্যাকরীদেরকে আপনার রহমত থেকে দূর করে দিন ।
আল্লাহ পাক আমাদেরকে হযরত ইমাম হুসাইনের ( আ:) জন্য কান্নাকাটি , মাতম ও শোক প্রকাশের পূণ্য ও সওয়াব দান করুন এবং আমাদেরকে ও আপনাদের সবাইকে আল - ই মুহাম্মাদের ( সা:) (( অর্থাৎ মহানবীর ( সা:) আহলুল বাইত )) অন্তর্ভুক্ত তাঁর ওয়ালী ইমাম মাহদীর ( আ:) সাথে ইমাম হুসাইনের ( আ.) পবিত্র রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণকারীদের অন্তর্ভুক্ত করে দিন ।
أَعْظَمَ اللّٰهُ أُجُوْرَنَا بِمُصَابِنَا بِالْحُسَيْنِ عَلَيْهِ السَّلَامُ وَ جَعَلَنَا وَ إِيَّاکُمْ مِنَ الطَّالِبِيْنَ بِثَارِهِ مَعَ وَلِيِّهِ الْإِمَامِ الْمَهْدِيِّ مِنْ آلِ مُحَمَّدٍ عَلَيْهِمُ السَّلَامُ .
ইয়া লাসারাতিল হুসাইন ( আ:)
يَا لَثَارَاتِ الْحُسَيْنِ .
হে হুসাইনের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ কারীরা ( মযলূম ইমাম হুসাইনের রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য জালিম ঘাতকদের বিরুদ্ধে উঠে রুখে দাঁড়াও ) ।
এ শ্লোগানটা হবে ইমাম মাহদী ( আ:) এবং তাঁর অনুসারীদের জনপ্রিয় বিপ্লবী শ্লোগান । কারণ অন্যায় ও তাগূতের বিরুদ্ধে কারবালায় সাইয়েদুশ শুহাদা ( শহীদদের নেতা ) ইমাম হুসাইনের ( আ:) ক্বিয়াম , আন্দোলন ও শাহাদাত আসলে আখেরুয যামানে ( শেষ যুগে অর্থাৎ কিয়ামতের আগে) ইমাম মাহদীর ( আ:) সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার বিপ্লব ও সংগ্রামের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে ।
তাই আশুরা হচ্ছে সকল অন্যায় , মিথ্যা ও তাগূতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের মুর্ত্য প্রতীক ।
আশুরা দেয় পুন:জাগরণের সুসংবাদ । আশুরা তরবারির উপর রক্তের বিজয় । আশুরা শাহাদাতের মাধ্যমে অনন্ত জীবনে উত্তরণের সোপান ।
আশুরা দেয় শোষণহীন ও অন্যায় মুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ ন্যায় ভিত্তিক মানব জীবনের প্রতিশ্রুতি ।
তাই আজ আমাদের উচিত ইমাম
হুসাইনের ( আ:) সুমহান আদর্শ ও কিয়াম থেকে সঠিক শিক্ষা নেয়া ।
লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ এবং গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান