
ভোকাল–এর বরাতে ইকনার প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন মুসলিম গবেষক ওয়াসিম খান তাঁর গবেষণায় ইসলামের বিরুদ্ধে “গোপন যুদ্ধ”-এর কিছু চমকপ্রদ মাত্রা প্রকাশ করেছেন।
এই যুদ্ধ অস্ত্র বা সেনাবাহিনীর মাধ্যমে নয়, বরং ভার্চুয়াল জগতে অ্যালগরিদম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এটি একটি সুসংগঠিত প্রচারণা, যার লক্ষ্য ইসলামী বিশ্বাসকে বিকৃত করা এবং তার প্রকৃত অর্থ থেকে শূন্য করে ফেলা।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মগুলো যেমন ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটক—মুসলমানদের পশ্চাদপদ বা সন্ত্রাসী হিসেবে উপস্থাপন করা, হিজাবকে উপহাস করা এবং শরিয়তের ধারণাগুলোকে “বিনোদনমূলক কনটেন্ট” বা “সামাজিক সমালোচনা”-এর নামে বিকৃত করার মাধ্যমে ইসলামফোবিক কনটেন্ট ছড়ানোর প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
প্রতিবেদনটি সতর্ক করে দিয়েছে যে এই প্রচারণাগুলো কেবলমাত্র শত্রুভাবাপন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত নয়; বরং গবেষণা কেন্দ্র, লবিগ্রুপ এবং রাজনৈতিক শাসকগোষ্ঠীও এর পেছনে রয়েছে, যারা ইসলামের ভিতর থেকেই তাকে ভেঙে দিতে চায়। তারা এমন এক সংস্করণের ইসলাম প্রচার করে যেখানে জিহাদ, হিজাব বা শরিয়ত অস্বীকার করা হয় এবং চেষ্টা করা হয় ধর্মকে তার আসল উপাদান থেকে খালি করে ফেলার।
গবেষণায় পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট দ্বিচারিতা তুলে ধরা হয়েছে—যখন উগ্রবাদীরা সন্ত্রাসী হামলা চালায়, তখন ইসলামকে দোষারোপ করা হয়; অথচ মুসলমানদের ওপর হামলা বা মসজিদে আগুন লাগানো হলে তা “আকস্মিক ঘটনা” বা “মানসিক সমস্যার ফল” বলে ব্যাখ্যা করা হয়।
প্রতিবেদনটি উপসংহারে বলছে, এই ধরনের যুদ্ধের আসল বিপদ কেবল আক্রমণে নয়, বরং এর মোকাবিলায় কার্যকর ইসলামী কৌশলের অভাবেও নিহিত। বর্তমান প্রতিক্রিয়াগুলো আবেগপ্রবণ, সাময়িক এবং গভীরতা ও প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা থেকে বঞ্চিত—যা এই নির্মম ভ্রান্ততাপূর্ণ তথ্যপ্রবাহ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন।
গবেষক তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন: “তারা বলে ইসলাম নারীদের প্রতি অবিচার করে। শরিয়ত নিষ্ঠুর। ইসলামী শাস্তিগুলো বর্বরোচিত। অথচ এসব দাবি সচরাচর সত্যের আলোয় যাচাই করা হয় না। ইসলাম নারীদের যে অধিকার দিয়েছে, তা যেকোনো আধুনিক সংবিধানের বহু শতাব্দী আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, অথচ তা খুব কমই উল্লেখ করা হয়। ইসলাম নারীর জন্য উত্তরাধিকার, সম্পত্তির মালিকানা, জ্ঞান অর্জন, সম্মান ও নিরাপত্তায় জীবনযাপনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। এগুলো পশ্চিমা উপহার বা লিবারাল আন্দোলনের দান ছিল না; বরং এগুলো ছিল আল্লাহপ্রদত্ত আইন। তবুও এই ইতিহাস ইচ্ছাকৃতভাবে আড়াল বা বিকৃত করা হয়েছে।
তার পরিবর্তে পৃথিবী যা প্রায়শই দেখে তা হলো কৌতুক ও ব্যঙ্গ। ইসলামকে একটি মিমে পরিণত করা হয়েছে। ভাইরাল কৌতুক ও কনটেন্ট মুসলমানদের পশ্চাদপদ, নিরক্ষর ও হিংস্র হিসেবে চিত্রিত করে। হিজাবকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়। নামাজকে উপহাস করা হয়। দাড়িকে বিদ্রূপ করা হয়। ইসলামী শিক্ষার সঙ্গে অপরিচিত মানুষের কাছে এগুলো হয়তো হাস্যরসাত্মক মনে হয়, কিন্তু এর প্রভাব অনেক গভীর। বহু তরুণ মুসলিম, যাদের নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান নেই, যখন এ ধরনের মাধ্যমে আক্রান্ত হয়, তারা অবচেতনে ইসলাম নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করে। এটি মোটেও আকস্মিক নয়।”
ইসলামের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আক্রমণের আড়ালে কী আছে?
এই সাইবার যুদ্ধের পেছনে শক্তিশালী শক্তিগুলো সক্রিয়: মিডিয়া লবি, মতাদর্শিক থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক এবং কখনও কখনও রাষ্ট্রপৃষ্ঠপোষক প্রচারণা। তাদের লক্ষ্য হলো সারা বিশ্বে ইসলামের চিত্র বিকৃত করা এবং তার চেয়েও বিপজ্জনকভাবে মুসলমানদের হৃদয়েই তা বিকৃত করা। ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ও ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদম প্রায়ই ইসলামী শিক্ষামূলক কনটেন্টকে দমন করে এবং বিপরীতে, ধর্মকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন বা আক্রমণকারী সামগ্রীকে জোরদার করে।
ইসলামফোবিয়ার সাইবার রূপ মোকাবিলায় নতুন কৌশল গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা
অন্য এক বিপজ্জনক প্রবণতা হলো তথাকথিত “উদারপন্থী” বা “মধ্যপন্থী” ইসলাম প্রচার। এই সংস্করণ সহজেই হিজাব, জিহাদ, শরিয়ত এবং মুসলিম পারিবারিক কাঠামোর মতো দিকগুলো মুছে দেয়। যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো এক ফাঁপা পরিচয়—যা দেখতে সেক্যুলার মতাদর্শের মতো হলেও তাতে ইসলামের লেবেল লাগানো থাকে। তরুণদের শেখানো হয় যে প্রকৃত ইসলাম হিংস্র ও সেকেলে, আর এই রিক্ত সংস্করণই বুদ্ধিবৃত্তিক।
এই বিভ্রান্তি আরও বেড়ে যায় যখন দায়েশ বা বোকো হারাম–এর মতো সহিংস গোষ্ঠীগুলোকে বৈশ্বিক পর্যায়ে ইসলাম সংজ্ঞায়িত করার সুযোগ দেওয়া হয়। যখন তারা নৃশংসতা চালায়, তখন পুরো ধর্মকে দোষী করা হয়। অথচ যখন মুসলমানরা ঘৃণার শিকার হয়—মসজিদে আগুন লাগানো হয়, হিজাবপরা নারীদের আক্রমণ করা হয়, স্কুলে শিশুদের হয়রানি করা হয়—তখন অপরাধীদের “মানসিক রোগী” বলা হয়, সন্ত্রাসী নয়। দ্বিচারিতা স্পষ্ট।
এই বৈষম্য কেবল মিডিয়াতে সীমাবদ্ধ নয়; এটি কাঠামোগত। এবং প্রতিটি মুসলমানের জিজ্ঞাসা করা উচিত: আমরা এর জন্য কী করছি? আমাদের প্রতিক্রিয়া সাধারণত আবেগপ্রবণ, অসংগঠিত ও সাময়িক। আমরা রাগান্বিত মন্তব্য করি, আবেগতাড়িত ভিডিও শেয়ার করি, কিন্তু ধারাবাহিকতা নেই। আমরা পরবর্তী ইসলামবিদ্বেষী অপমানের অপেক্ষায় থাকি, কিন্তু খুব কমই প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেই।
ইসলামের বিরুদ্ধে সাইবার যুদ্ধে প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা
এখন সময় এসেছে নতুন ধরনের প্রতিরোধের: বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ। আমাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে বর্ণনাটি পুনর্দখল করতে হবে। হ্যাঁ, আমাদের গবেষক দরকার। তবে পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক, সফটওয়্যার ডেভেলপার, কবি, ডিজাইনার ও কনটেন্ট প্রযোজকও দরকার, যারা ইসলামের গল্পকে এমনভাবে বলতে পারবেন যা আধুনিক বিশ্ব উপলব্ধি করতে পারে।
আমাদের এমন কনটেন্ট প্রয়োজন যা শিক্ষা দেবে, অনুপ্রেরণা জোগাবে এবং ঈমানকে শক্তিশালী করবে— কুমেন্টারি, যা বিজ্ঞানে ও সমাজে ইসলামের অবদান তুলে ধরবে। অ্যানিমেশন, যা শিশুদের রাসূলুল্লাহ (সা.)–এর জীবনচরিত শেখাবে। ইনস্টাগ্রাম ভিডিও, যা ৩০ সেকেন্ডে শরিয়তের যুক্তি ব্যাখ্যা করবে। পডকাস্ট, যা স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে আধুনিক সংশয়সমূহের উত্তর দেবে।
আমাদের আরও উন্নত অনলাইন কৌশল প্রয়োজন: প্ল্যাটফর্মগুলোর কার্যপদ্ধতি বোঝা, কীভাবে ট্রেন্ড তৈরি হয়, কীভাবে এসইও, হ্যাশট্যাগ ও স্টোরিটেলিং ব্যবহার করতে হয়—যাতে যারা সত্য খুঁজছে তারা আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারে। কারণ মানুষ খুঁজছে, কিন্তু সবসময় আমাদের খুঁজে পাচ্ছে না।
তবে কেবল কনটেন্ট ও সৃজনশীলতা যথেষ্ট নয়। আমাদের আধ্যাত্মিক শক্তিও প্রয়োজন। কনটেন্টের পাশাপাশি তাকওয়া, ধৈর্য ও দোয়া আবশ্যক; কারণ এটি শুধু একটি মিডিয়া যুদ্ধ নয়—এটি একটি আধ্যাত্মিক পরীক্ষা। 4296534