একটি গলি যা অন্য গলির মতো নয়, একজন বয়স্ক ফিলিস্তিনি মহিলা ঝুঁকে কিন্তু দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছেন এবং একটি ক্যামেরার সামনে বলছেন, যা তাকে ইতিহাসের রেকর্ড হিসাবে চিত্রায়িত করছে।
তিনি বলছেন 'আমি এই ভূমিতে আমার রক্তের শেষ ফোঁটাও ঝরাবো কিন্তু আমি কখনও আমার ভূমি ত্যাগ করব না।'
এই কণ্ঠস্বর হাজার হাজার কণ্ঠস্বরের সাথে মিলে যায় যারা গাজাকে অবরুদ্ধ শহর হিসেবে দেখে না বরং সমসাময়িক মানুষের জন্য নিজ 'ভূমিতে থাকার' সবচেয়ে বড় শিক্ষার দৃশ্য হিসেবে দেখে।
মানবিক মাত্রা: দুর্যোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছোট ছোট আখ্যান
আজ গাজাকে পৃথিবীর যেকোনো মানচিত্র বা সামাজিক প্রতিবেদনের চেয়েও বেশি সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে দৈনন্দিন মানব জীবনের চাল-চিত্র দিয়ে। দশ বছরের একটি ছেলে তার বাড়ির ভাঙা সিঁড়িতে বসে আছে এবং আমরা জানি না যে তার পরিবারের কোন সদস্য এই কঠিন পথে তার সাথে যাচ্ছে!
পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ভাই, একজন বাবা তার হাতে তার বাড়ির চাবি ধরে আছেন; এমন একটি বাড়ির চাবি যা আর বিদ্যমান নেই কিন্তু এখনও তার পরিচয়ের অংশ!
এই ছবিগুলোকে একসাথে দেখা একটি ট্র্যাজেডির চেয়েও বেশি কিছু এবং এটা বলতে হবে যে এগুলি প্রতিরোধের প্রতীক। ফিলিস্তিনি সাহিত্যে 'সামুদ' নামে পরিচিত প্রতিরোধ এমন একটি শব্দ যার অর্থ সামরিক প্রতিরোধের বাইরে ভূমির গভীরে থাকা নিজের শিকড় সংরক্ষণ করা।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের কবিতা এবং সাহিত্য
বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে মাহমুদ দারবিশ, সামিহ আল-কাসিম, ফাদউই তৌকান এবং তাদের মতো ফিলিস্তিনি কবিরা বারবার একই বিষয়বস্তুকে সম্বোধন করেছেন। তাদের কলমে এসেছে, মানুষ এবং তার মাতৃভূমির মাটির মধ্যে অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। ফিলিস্তিনের কবিতা ও সাহিত্য কেবল শিল্পই নয় বরং সেই প্রজন্মের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাষাও ছিল। তাদের গণমাধ্যম কিংবা সরকারী সমাবেশে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি ছিল না। যখন আমরা দেখি একজন ফিলিস্তিনি মহিলা তার শিশুকে ধরে ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আছেন, তখন তিনি আসলে রূপক এবং শব্দে এই কবিদের তৈরি করা কথাই বলছেন: সেই স্বদেশ এমন কিছু নয় যা পরিবহন বা বিক্রি করা যায়; স্বদেশ এমন একটি জায়গা যেখানে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও থাকতে হবে।
রাজনীতি এবং ইতিহাসে "থাকতে থাকা" এর অর্থ
গাজার ভূমি এবং বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার অর্থ কেবল জীবন বাঁচানো নয় এর অর্থ ইতিহাস ত্যাগ করা। ১৯৪৮ সালে নাকবা দিবস বা 'ইয়োম আল-নাকবা' এর অভিজ্ঞতা এখনও তাদের মনে জীবন্ত হয়ে আছে। যখন লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনি ফেরার আবার ঘরে ফেরার আশায় তাদের বাড়ি ছেড়েছিল কিন্তু কখনও তারা ফিরে আসতে পারেনি। আজ যারা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা আসলে ইতিহাসের সাথে কথা বলছে। আসুন আমরা একবার আমাদের সাথে যা ঘটেছিল তার পুনরাবৃত্তি না করি।
আজকের গাজাকে শতাব্দীর সবচেয়ে বড় প্যারাডক্স হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। একটি ছোট ভৌগোলিক অঞ্চল যা একই সাথে 'বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক অঞ্চল' এবং 'দেশপ্রেমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণীকক্ষ।'
ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বৃদ্ধা মহিলার নাম হয়তো কোনও ইতিহাসের বইতে লেখা থাকবে না কিন্তু তিনি এবং তার মতো হাজার হাজার মানুষ এই শব্দগুলোকে নতুন অর্থ দিয়েছেন। অক্সিজেন মেশিন বন্ধ এবং পানির পাইপ খালি থাকা সত্ত্বেও স্বদেশ এখনও বেঁচে আছে।#পার্সটুডে