IQNA

ইরানে ইসলামী বিপ্লবের গৌরবময় অগ্রযাত্রার ৪১ বছর (পর্ব- দশ)

19:21 - February 10, 2020
সংবাদ: 2610205
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইরানে সংঘটিত ইসলামী বিপ্লব নানা ধরনের ঐতিহাসিক সাফল্য ও মহা-বিস্ময়ের ভরপুর।

বার্তা সংস্থা ইকনা'র রিপোর্ট: এ বিপ্লব সফল হওয়ার পর টাইম ম্যাগাজিন পাশ্চাত্যকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিল, গোটা মুসলিম উম্মাহ এক হতে যাচ্ছে। ইরানের ইসলামী বিপ্লব মুসলমানদের প্রথম কেবলার দখলদার ইসরাইলের হাত থেকে ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনি জাতিকে মুক্ত করার আন্দোলনকে জোরদার করে তোলে। আর তাই এ বিপ্লব সফল হওয়ার পরপরই তৎকালীন পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং তিনি সরাসরি ইমাম খোমেনির সঙ্গে সাক্ষাত করে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে সংগ্রামী ভূমিকার রাখার জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

উল্লেখ্য ইরানে ইসলামী বিপ্লবের আগে হাজার হাজার মার্কিন ও ইসরাইলি সেনা এই দেশটিতে অবস্থান করত। তাদের মোট সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারেরও বেশি। কিন্তু ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ায় এইসব মার্কিন ও ইহুদিবাদী সেনা ইরান ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।

ইরানে ইসলামী বিপ্লবের আগে স্বৈরাচারী রাজা শাহ ছিল বর্ণবাদী ও দখলদার ইসরাইলের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। মার্কিন সরকার দেশে দেশে নানা যুদ্ধ ও সংঘাতে তৎকালীন শাহী ইরানের অর্থ ও অস্ত্র ব্যবহার করত মজলুম বা নির্যাতিত এবং প্রতিরোধ শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে। এখন যেমন সৌদি সরকার মার্কিন সরকারের ঘোষিত 'দুধদাতা গাভীর' ভূমিকা পালন করছে তখন শাহ সরকারও একই ধরনের ভূমিকাই পালন করত। আরব দেশগুলো যখন ইহুদিবাদী ইসরাইল ও ইসরাইলের মদদদাতা পশ্চিমা সরকারগুলোর ওপর তেল-অবরোধ আরোপ করে তখন ইরানের শাহ প্রকাশ্যেই দম্ভভরে ঘোষণা করেছিলেন যে ইরান ইসরাইলকে বিনামূল্যে জ্বালানী তেল সরবরাহ করবে এবং শাহ তা বাস্তবায়নও করেছিল।

১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের চূড়ান্ত সাফল্যের কয়েক দিন আগে অর্থাৎ ৮ ফেব্রুয়ারি বিমান বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কমান্ডার, পাইলট ও সদস্যরা ইসলামি বিপ্লবের স্থপতি ইমাম খোমেনি (রহ.)'র সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। বিপ্লবের আগে তাগুতি রাজতান্ত্রিক সরকারের খুব কাছের বাহিনী হিসেবে পরিচিত ছিল বিমান বাহিনী। কিন্তু এই বাহিনীই ইসলামি বিপ্লবের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করলে রাজতান্ত্রিক সরকার বিস্মিত হয়ে যায়। কারণ তাদের কাছে এটা ছিল অপ্রত্যাশিত।

এই ঘটনার একটি শিক্ষা হল, তাগুতি ও খোদাদ্রোহী শক্তি এমন জায়গা থেকে আঘাতপ্রাপ্ত হয় যা তাদের কাছে অকল্পনীয়।

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের আরেকটি স্থায়ী বা অব্যাহত মহা-বিস্ময় হল ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ও প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের মত নানা মহাকল্যাণ উপহার দেয়ার কারণে এ বিপ্লবের বিজয়-বার্ষিকীর শোভাযাত্রাসহ জাতীয় নানা ইস্যুতে ও বিশ্ব-কুদস দিবসের মত আন্তর্জাতিক নানা ইস্যুতে সর্বোচ্চ নেতার আহ্বানে প্রতি বছরই কোটি কোটি ইরানি জনগণের রাজপথে নেমে আসার দৃশ্য। পাশ্চাত্যের তথ্য-সাম্রাজ্যবাদী সংবাদ মহল এ ধরনের মহাসমাবেশের খবর এড়িয়ে যায় এবং এ জাতীয় খবর প্রচার করলেও সর্বস্তরের ইরানি জনগণের বিপুল মাত্রায় সমাবেশে যোগ দেয়ার অংশটুকু এড়িয়ে যায় বা খুব বিকৃতভাবে তুলে ধরে। যেমন, কোটি কোটি ইরানির অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশগুলোকেও হাজার হাজার লোকের বা দশ বিশ সহস্র মানুষের সমাবেশ বলে উল্লেখ করে! অন্যদিকে এইসব সংবাদ মাধ্যমই ইসলামী সরকারের বিরুদ্ধে কয়েক শত ব্যক্তির সমাবেশকেও ইরানি জাতির সমাবেশ বা প্রতিবাদ বলে উল্লেখ করে! আর বিশ্বের নানা দেশের প্রধান ও বেশিরভাগ সংবাদ মাধ্যমও সাধারণত এইসব মিথ্যা সংবাদের আলোকেই সংবাদ পরিবেশন করে থাকে।

কিন্তু সত্যকে চেপে রাখা যায় না এবং সত্যের বিজয় যেমন অনিবার্য তেমনি মিথ্যার কৃত্রিম মেঘগুলো কেটে বিশ্বের সচেতন মানুষের কাছে সঠিক খবরগুলো ঠিকই পৌঁছে যায় এবং মিথ্যা প্রচারণাগুলোর ভিত্তিহীনতা ফুটে উঠে। আর এমনই ধরনের ইরান-বিরোধী কিছু আজগুবি মিথ্যা প্রচারণা হল: ইরানের ইসলামী বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ ইসলামের নামে বিশ্বের বুকে আবারও পারস্য সাম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে চায়! ইরানে সুন্নিদের ওপর নির্যাতন করা হয় এবং তাদের ন্যায্য অধিকার দেয়া হয় না! ইরানের কুদস্ ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলাইমানি ইরাক ও সিরিয়ার কোটি কোটি বা লাখ লাখ সুন্নিকে হত্যা করেছে!- ইত্যাদি!

সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ইসলামী ইরানকে সুন্নি-বিদ্বেষী বা সুন্নিদের জাগরণ-বিরোধী শক্তি বলে প্রচার করে মুসলমানদের মধ্যে এ মহাবিপ্লবের জনপ্রিয়তা ও আবেদনকে কমাতে চেয়েছিল। কিন্তু সুন্নি মুসলমান অধ্যুষিত ফিলিস্তিনের প্রতি অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে ইরানের সবচেয়ে বেশি সাহায্য-সমর্থন, মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল-আকসাকে উদ্ধারের জন্য ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে বিশ্ব-কুদস দিবসের প্রচলন এবং আফগানিস্তান, কাশ্মির ও বসনিয়ার মত সুন্নি প্রধান দেশগুলোর মজলুম জনগণের প্রতি ইরানের সর্বাত্মক সাহায্য-সমর্থন সাম্রাজ্যবাদীদের এই ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিয়েছে।

ইরানের ইসলামী বিপ্লবী নেতৃবৃন্দে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা ও হজ্বের মত বিশ্ব-মুসলিম সম্মেলনকে সাম্রাজ্যবাদী ও বিভেদকামী শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। ইরানের নেতৃত্বেই গঠন করা হয়েছে মুসলিম মাজহাবগুলোকে ঘনিষ্ঠতর করার বিশ্ব-সংস্থা। ইসলামী ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর যে কোনো তৎপরতাকে হারাম বলে ঘোষণা করেছেন ইসলামী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এবং মুসলিম ঐক্য-বিনাশী 'ব্রিটিশপন্থী শিয়া ও মার্কিনপন্থী সুন্নিদের' ব্যাপারে সতর্ক থাকতে মুসলিম উম্মাহর প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন। ইমাম খোমেনী (র) বলেছিলেন, যারা শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করছে তারা শিয়াও নয় সুন্নিও নয় বরং তারা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের সেবক! সন্ত্রাসবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ইরানের ইসলামী সরকারের স্পষ্ট ও আন্তরিক সংগ্রামের কারণে ইরাক ও সিরিয়ার সুন্নি এবং কুর্দি সুন্নি মুসলমানদের কাছেও ইসলামী ইরানের জনপ্রিয়তা বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই দেখা গেছে ইরাক ও সিরিয়াতে শিয়া ও সুন্নি মুসলমানরা ইরানের সহায়তা নিয়ে দায়েশ বা আইএস-এর মত ওয়াহাবি-প্রভাবিত তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছে। ফলে এসব অঞ্চলে ইসরাইলি ও মার্কিন মদদপুষ্ট তাকফিরি গোষ্ঠীগুলো প্রায় নির্মূল বা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে।
সূত্র: parstoday

captcha