IQNA

মোবাইল আসক্তি সময় নষ্টের আধুনিক ফাঁদ

15:43 - September 24, 2025
সংবাদ: 3478125
ইকনা- মুসলিম স্কলার ড. ইউসুফ আল-কারযাভি বলেন, ‘প্রযুক্তির ব্যবহার যদি মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, তবে তা হারাম বিনোদনের মতোই ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।’
মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মূলধন হচ্ছে সময়। সময়ই মানুষের জীবন। মুহূর্ত থেকে মুহূর্তের প্রতিটি নিঃশ্বাস আমাদের কাছে টেনে নিচ্ছে মৃত্যু। অথচ আজকের তরুণসমাজের এক বড় অংশ এই মূল্যবান সময়ের অপচয় করছে মোবাইল আসক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে।
 
 
যদিও প্রযুক্তি আল্লাহর এক নিয়ামত। কিন্তু নিয়ামতের অপব্যবহার নিয়ামতকে পরিণত করে অভিশাপে। মোবাইল ফোন যদি জ্ঞান অর্জন, যোগাযোগ, দাওয়াহ, কিংবা হালাল কর্মক্ষেত্রে ব্যবহার হয়, তবে তা কল্যাণকর। কিন্তু যখন তা নিরবচ্ছিন্ন বিনোদন, গেমস, টিকটক, ইউটিউব বা অশ্লীলতায় নিমজ্জিত থাকার মাধ্যম হয়, তখন তা শুধু সময়হানি নয়, নৈতিকতা ও ঈমান ধ্বংসেরও কারণ হয়ে উঠতৈ পারে।
 
 
সময়ের গুরুত্ব ও কোরআনের শিক্ষা
 
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সময় নিয়ে শপথ করেছেন, ‘শপথ সময়ের, নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত, তবে তারা নয় যারা ঈমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে, পরস্পরকে সত্য ও ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।’ (সুরা : আল-আসর) এখানে স্পষ্ট যে সময়কে সঠিকভাবে কাজে না লাগালে মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, ‘যদি আল্লাহ মানুষের জন্য শুধু এ সুরাই নাজিল করতেন, তবে তা মানুষের জন্য যথেষ্ট হতো।’ (তাফসির ইবনে কাসির)
 
এ থেকে বোঝা যায়, সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানো ইসলামী জীবনের মূল ভিত্তি।
 
 
অথচ মোবাইল আসক্ত তরুণরা প্রাত্যহিক জীবনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনর্থক বিনোদনে কাটিয়ে দিচ্ছে, যা সুরা আসরের আলোকে স্পষ্ট ক্ষতি।
 
হাদিসের আলোকে সময় অপচয়ের ক্ষতি
 
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দুটি নিয়ামতের ব্যাপারে অনেক মানুষ প্রতারিত হয়—সুস্থতা ও অবসর।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪১২)
 
আজকের তরুণসমাজ সুস্থ দেহ ও অফুরন্ত অবসর পেয়েও মোবাইলে গেম, অকারণ চ্যাট, সামাজিক মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় স্ক্রলিংয়ে ডুবে থেকে প্রতারিত হচ্ছে। অথচ এই অবসর ব্যবহার হতে পারত কোরআন পাঠে, নতুন জ্ঞান অর্জনে, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জনে কিংবা সমাজসেবায়।
 
আরেক হাদিসে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘কিয়ামতের দিন বান্দার দুই পা সরবে না, যতক্ষণ না তাকে চারটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে; তার জীবন কিভাবে কাটিয়েছে, তার যৌবন কিভাবে কাটিয়েছে, তার ধন-সম্পদ কোথায় উপার্জন করেছে ও কোথায় ব্যয় করেছে, আর তার জ্ঞান দিয়ে কী করেছে।
 
 
’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৪১৬)
যাঁরা যৌবনের মূল্যবান মুহূর্তগুলো মোবাইল আসক্তির অগ্নিতে পোড়াচ্ছেন তাঁরা একটু ভেবে দেখবেন কতটা ভয়ংকর জবাবদিহি অপেক্ষা করছে।
 
মোবাইল আসক্তি নতুন যুগের ‘লাহও’ বা অবান্তর কথা
 
পবিত্র কোরআনে এসেছে : ‘মানুষের কেউ আছে যারা বিভ্রান্ত করার জন্য অবান্তর কথাবার্তা ক্রয় করে, যাতে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে দেয়।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ৬)
 
আয়াতের আরবি শব্দ ‘লাহওয়াল হাদিস’ এর অর্থ হচ্ছে অসার বা বেহুদা কথা।  তাফদিরবিদরা বলেন, এই আয়াতের অন্তর্নিহিত অর্থ হলো যেকোনো নিরর্থক ব্যস্ততা, যা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ ও দায়িত্ব থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আজকের যুগে মোবাইল আসক্তি এই ‘লাহও’ বা নিরর্থক ব্যস্ততার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
 
ইসলামী স্কলারদের দৃষ্টিভঙ্গি
 
ইবনে কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘সময় হত্যা করা মানে প্রকৃতপক্ষে আত্মহত্যা করা।’ (আল-ফাওয়ায়েদ)
 
ইমাম গাজ্জালি (রহ.) লিখেছেন, ‘মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অমূল্য রত্ন; যে তা নষ্ট করল, সে নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্ত।’ (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন)
 
আধুনিক যুগের  মুসলিম স্কলার ড. ইউসুফ আল-কারযাভি বলেন, ‘প্রযুক্তির ব্যবহার যদি মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, তবে তা হারাম বিনোদনের মতোই ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।’
 
ইসলামের সংযম ও মোবাইল ব্যবহারের নীতি
 
ইসলাম কোনো নিয়ামতকে নিষিদ্ধ করে না, বরং অপব্যবহার থেকে বিরত থাকতে শেখায়। আল্লাহ বলেন, ‘খাও, পান করো, কিন্তু অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩১)
 
এখানে শুধু খাদ্য-পানীয় নয়, বরং জীবনের সব ক্ষেত্রে অপচয়ের নিন্দা করা হয়েছে। মোবাইলের অপব্যবহারও এই অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত।
 
মোবাইল ফোন আল্লাহর এক নিয়ামত, কিন্তু এর প্রতি আসক্তি তরুণসমাজকে সময়হানি, জ্ঞানহানি, চরিত্রহানি ও ঈমানহানির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইসলামের শিক্ষা হলো সংযম। যার মর্ম হলো সময়কে সঠিক কাজে ব্যয় করা, অবসরের সদ্ব্যবহার করা এবং নিয়ামতের অপব্যবহার থেকে বাঁচা।
 
অতএব, তরুণদের উচিত অবসর মোবাইল আসক্তিতে নষ্ট না করে ইবাদত, জ্ঞানচর্চা, সৃজনশীলতা ও সমাজের কল্যাণে ব্যয় করা। তাহলেই সময় হবে বরকতময়, জীবন হবে সফল এবং আখিরাত হবে শান্তিময়।
 
লেখক : শাব্বির আহমদ, শিক্ষার্থী, তাকমিল ফিল হাদিস জামিয়া ইমদাদিয়া দারুল উলুম মুসলিম বাজার মিরপুর, ঢাকা
captcha