এই মসজিদগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে, প্রতিটি স্থাপনা যেন এক একটি অধ্যায়—শিল্পের বিবর্তন, ধর্মীয় অনুরাগ ও সময়ের সাথে এক অন্তহীন সংলাপের সাক্ষী।
প্রাচীন জামে আতিক মসজিদ শিরাজের ইসলামি ঐতিহ্যের প্রাচীনতম নিদর্শনগুলোর একটি, আর “গোলাপি মসজিদ” নামে পরিচিত "নাসিরুল-মুলক মসজিদ"- একটি কাজার-যুগের রত্ন যা রঙ, আলো ও নকশার অলৌকিক সমন্বয়ের জন্য বিশ্বখ্যাত। "ওয়াকিল মসজিদ" জান্দ রাজবংশের স্থাপত্যিক প্রজ্ঞা ও মহৎ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, আর সূক্ষ্ম সৌন্দর্যের "মোশির মসজিদ" আজও ক্বাজার যুগের শিল্প ঐতিহ্যের এক নীরব সাক্ষী, যা সংরক্ষণের সংকটে টিকে আছে।
প্রতিটি মসজিদ তার নিজস্ব ইতিহাস ও শিল্পকর্মের মাধ্যমে শিরাজকে কেবল বাগান ও কবিতার শহর নয়, বরং ইসলামি শিল্প ও আধ্যাত্মিকতার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে—যেখানে প্রতিটি টালি, খিলান ও স্তম্ভ বিশ্বাস ও সৃষ্টিশীলতার গল্প বলে যায়।
শিরাজের পুরাতন জামে মসজিদ
শিরাজের প্রাচীন জামে মসজিদ, যাকে সম্মানিতভাবে আতিক (প্রাচীন) মসজিদও বলা হয়। এটি শহরের আধ্যাত্মিক ও স্থাপত্য ইতিহাসের একটি মৌলিক স্তরকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা ৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে (২৮১ হিজরি) সাফাভি রাজবংশের সময় নির্মিত হয় এবং সমগ্র ইরানের প্রাচীনতম ইসলামি স্মৃতিচিহ্নগুলির মধ্যে একটিতে পরিণত হয়।
এর সবচেয়ে অনন্য উপাদান হলো কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত 'খোদায়ীখানেহ' (আল্লাহর ঘর) বা 'দারুল-মুশাফ'—একটি রহস্যময় ঘনকাকৃতি কাঠামো, যা শাহ শেখ আবু ইসহাক ইঞ্জু কর্তৃক ৮ম শতকে নির্মিত, যিনি খ্যাতিমান কবি হাফেজের সমসাময়িক ছিলেন। কথিত আছে যে, হাফেজ নিজেই এই ভবনটির চারদিকেই পবিত্র পরিক্রমা (তাওয়াফ) করতেন।
এই স্থাপনাটি কখনো কখনো কাব্যিকভাবে 'দ্বিতীয় কাবা' বলা হয়, যেখানে কুরআন তিলাওয়াত, প্রতিলিপিকরণ ও সংরক্ষণের কাজ হতো। এর চার কোণের মিনার এবং পাথর ও প্লাস্টারের নির্মাণ বিশাল প্রাঙ্গণের মধ্যে ভক্তি ও শিক্ষার একটি শক্তিশালী কেন্দ্রবিন্দু তৈরি করেছিল।
উত্তর দিকের প্রবেশপথ, যা অত্যন্ত সুশোভিত এবং "বারো ইমামের দরজা" নামে পরিচিত। এর উপর শিয়া ইমামদের নাম সংবলিত টাইলসের জন্য, সাফাভি যুগে গৃহীত জাঁকজমকপূর্ণ পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার প্রদর্শনী। এর চমৎকার মুকারনাস ভল্টিং এবং জটিল মোজাইক টাইলসের শিলালিপি রাজবংশজুড়ে পবিত্র শিল্পের স্থায়ী পৃষ্ঠপোষকতার সাক্ষ্য দেয়।
আজ মসজিদটি দীর্ঘ পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের কারণে আংশিকভাবে ঢাকা অবস্থায় রয়েছে—এর ঐশ্বর্য এখনও জ্বলজ্বল করছে, তবে সময়ের ভারে যেন কিছুটা স্তব্ধ হয়ে আছে।
নাসিরুল-মুলক মসজিদ
কাজার যুগের একটি উৎকৃষ্ট স্থাপত্য ও আলোকশিল্পের এক বিস্ময়কর সমন্বয় 'নাসিরুল-মুলক মসজিদ'। নাসির আল-মুলকের আদেশে মির্জা হাসান আলি সৌন্দর্যমন্ডিত এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটির নকশা করেন মোহাম্মদ হাসান আল মেমার এবং মোহাম্মাদ রেজা কাশি-সাজ ই শিরাজি।
নাসিরুল মুলক মসজিদটির কাঁচগুলো সাজানো হয়েছে বিভিন্ন ডিজাইনে। প্রবেশদ্বারের “মোতির খিলান” সম্পূর্ণ সাত রঙের টালি দিয়ে মোড়ানো, যেখানে গোলাপ ও লিলির নকশা শিরাজের প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা জানায়। তবে আসল জাদু দেখা যায় পশ্চিম দিকের শাবেস্তানে (নিচতলায়)। সকালের সূর্য যখন রঙিন কাচের জানালা দিয়ে প্রবেশ করে, তখন আলো ছড়িয়ে পড়ে পারস্য কার্পেটের ওপর, আর রঙিন ছায়ায় ভেসে ওঠে খিলান ও স্তম্ভ। সেই মুহূর্তে মসজিদটি যেন এক জীবন্ত চিত্রকর্মে রূপ নেয়— যা আধ্যাত্মিকভাবে মনোরম এবং শিল্পগতভাবে অতুলনীয়।
নাসিরুল-মুলক মসজিদ তাই কেবল এক ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং এক জীবন্ত কবিতা—যেখানে আলোক ও বিশ্বাসের মেলবন্ধনে জন্ম নেয় পরম সৌন্দর্য।
ওয়াকিল মসজিদ
১৮শ শতকে কারিম খান যান্দের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয় ওয়াকিল মসজিদ। এই “রিজেন্ট মসজিদ” যান্দ রাজবংশের স্থাপত্য মহিমার এক অনন্য উদাহরণ।
মসজিদের ভেতরে রয়েছে দু’টি চত্বর। এর মধ্যে দক্ষিণ দিকের চত্বরটি নির্মিত হয়েছে পাথর দিয়ে নির্মিত পিলারের উপর। প্রতিটি পিলার একখণ্ড পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছে এবং এসব পাথরে কোনো জোড়া নেই। এরকম ৪৮টি পিলারের উপর নির্মিত বিশাল ছাদবিশিষ্ট মসজিদের দক্ষিণ চত্বরটি উত্তর দিকের চত্বরের চেয়ে তুলনামূলক বেশি সুন্দর। এসব পিলারের প্রত্যেকটি ৫ মিটার উঁচু এবং এগুলোর ডায়ামিটার ৮০ সেন্টিমিটার।
মসজিদের প্রবেশপথে মাথার উপর সুন্দর কারুকার্য খচিত টাইলস স্থাপন করা হয়েছে। এই পথ অতিক্রম করামাত্র দু’টি প্রবেশপথকে ডানে ও বামে দু’দিকে চলে যেতে দেখা যায়। কয়েক মিটার যাওয়ার পর প্রায় ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বসানো রয়েছে মসজিদের মূল চত্বরে প্রবেশের রাস্তা। সুলতানি মসজিদের প্রবেশপথের এই বৈচিত্রের কারণ হলো- ক্বিবলামুখী এই মসজিদের এক প্রান্ত শিরাজের বড় বাজারের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। সেই বাজার থেকে মসজিদে প্রবেশের জন্য একটি সোজা পথ রাখতে গিয়ে এর ভেতরে এরকম বাকা পথ তৈরি করতে হয়েছে।
মসজিদের মূল প্রবেশপথ এটির উত্তর প্রান্তে অবস্থিত। দুই টুকরা বিশাল কাঠ দিয়ে যান্দ শাসকদের আমলে এটি তৈরি হয়েছে। এগুলোর প্রতিটি কাঠ ৮ মিটার লম্বা ও ৩ মিটার চওড়া। মসজিদের আঙিনা সাজানো হয়েছে বড় বড় পাথর কেটে। আঙিনাটি বর্গাকৃতির। এটির ঠিক মাঝখানে রয়েছে ওজুখানা। আঙিনার চারদিকে স্থাপন করা হয়েছে ছোট ছোট তাক যেখানে মুসল্লিদের জন্য রয়েছে কুরআন ও হাদিস’সহ অসংখ্য ধর্মীয় পুস্তক।
এই স্থাপনাটিকে ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক ম্যাডাম দিয়ুলাফোয় “প্রতিটি টালিই এক একটি শিল্পকর্ম” বলে প্রশংসা করেছিলেন। ওয়াকিল মসজিদ জান্দ রাজবংশের সেই অঙ্গীকারের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ও শিল্পগতভাবে উজ্জ্বল একটি স্থাপত্যের মাধ্যমে এক স্থায়ী অবদান রেখে যাওয়ার প্রচেষ্টা প্রতিফলিত হয়।
মোশির মসজিদ
কাজার যুগের একটি বিশিষ্ট ধর্মীয় স্মারক- 'মোশির মসজিদ'- উনবিংশ শতকের ইরানি স্থাপত্যের পরিশীলিত ও নান্দনিক সংবেদনশীলতার প্রতিনিধিত্ব করে। আবুলহাসান খান মোশিরুল-মুলকের নির্দেশে এটি নির্মিত হয় এবং এর অনন্য ও শিল্পগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ টাইলওয়ার্কের জন্য খ্যাতি লাভ করে।
মসজিদটির টালি শিল্পে এমন সূক্ষ্ম নকশা দেখা যায় যা ইরানের অন্য কোথাও খুব কমই পাওয়া যায়। তবে সাম্প্রতিক পরিদর্শনে দেখা গেছে, দেয়াল ও ছাদে ফাটল দেখা দিয়েছে, যা এর সংরক্ষণের জন্য উদ্বেগজনক।
এই কারণে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞরা বিস্তারিত গবেষণা শুরু করেছেন এবং একটি পূর্ণাঙ্গ পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা প্রণয়ন করছেন, যাতে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবেও পুনর্জীবন লাভ করতে পারে।
শিরাজের এই মসজিদগুলো কেবল ইট ও টালির স্থাপনা নয়—এগুলো ইতিহাস, বিশ্বাস, শিল্প ও আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রবিন্দু। এখানে আলো কেবল প্রতিফলিত হয় না, বরং প্রার্থনায় রূপ নেয়; আর প্রতিটি স্থাপত্যিক নিদর্শন মানবিক সৌন্দর্যের এক চিরন্তন অনুরণন হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে।#
পার্সটুডে