
মহানবী মুহাম্মাদ (সা)'র আহলে বাইতের ধারায় জন্ম-নেয়া সপ্তম ইমাম হযরত আবুল হাসান মুসা ইবনে জাফর (আ.) জন্ম গ্রহণ করেন হিজরি ১২৮ সনে এবং শাহাদাত বরণ করেন ১৮৩ হিজরিতে। কাযিম, আবদু সালিহ (সৎ বান্দাহ), বাবুল হাওয়ায়েজ (নানা সমস্যা সমাধানের দরজা) ইত্যাদি তাঁর উপাধি। রাগ সংবরণে অশেষ ধৈর্যের জন্যই এই মহান ইমামকে বলা হত কাযিম। তাঁর পিতা ছিলেন মহানবীর (সা) আহলে বাইতের ধারায় জন্ম-নেয়া ষষ্ঠ ইমাম ও বিশ্ব-বিশ্রুত ইসলামী মনীষী হযরত জাফর আস সাদিক (আ.)। পিতার শাহাদাতের পর ইমাম হন হযরত মুসা কাযিম (আ)। তাঁর ইমামতির জীবন ছিল ৩৫ বছর।
তিনি ছিলেন পিতা ইমাম জাফর সাদিক (আ.)'র মতই নির্ভীক ও ন্যায়পরায়ণ এবং জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার। পিতার মহত গুণগুলোর সবই অর্জন করেছিলেন ইমাম মুসা কাযিম (আ.)। তাঁর ৩৫ বছরের ইমামতির জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে কারাগারে ও নির্বাসনে। জালিম আব্বাসিয় খলিফারা তাঁকে মদিনা থেকে বাগদাদে নিয়ে আনে যাতে জনগণের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও তাদের ওপর এই মহান ইমামের প্রভাব বিস্তার বন্ধ হয়ে যায়। ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে জনগণকে দিক-নির্দেশনা দেয়ার দায়ে তাঁকে কারাবন্দি করে রাখে আব্বাসীয় সরকার। আব্বাসীয় জালিম শাসকদের মধ্যে মনসুর, মাহদি, হাদি ও হারুন ছিল তাঁর সমসাময়িক।
এই মহান ইমামের সবচেয়ে বিখ্যাত সন্তান হলেন ইমাম আলী ইবনে মুসা আর রেজা (আ) এবং কন্যা হযরত মাসুমা (সা. আ) যাঁদের পবিত্র মাজার রয়েছে ইরানের মাশহাদ ও কোম শহরে।
একত্ববাদ, ইমামত, নবুওত ও পরকালসহ ধর্মীয় নানা বিষয়ে ইমাম মুসা কাযিমের নানা বাণী এবং নৈতিক চরিত্র গঠন বিষয়ে নানা উপদেশ, সংক্ষিপ্ত ও দীর্ঘ হাদিস রয়েছে। তিনি অনেক ছাত্র ও আলেম গড়ে তুলেছিলেন এবং রেখে গেছেন যোগ্য উত্তরসূরি ও পবিত্র বংশধারা। ইহুদি ও খ্রিস্টান কোনো কোনো পণ্ডিতের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক বা সংলাপ ও নানা প্রশ্নের জবাব ইতিহাসে সংরক্ষিত রয়েছে। মুসনাদের ইমাম আল কাযিম নামক বইয়ে এ মহান ইমামের তিন হাজারেরও বেশি হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম কাযিমের আধ্যাত্মিক খ্যাতি, জ্বালাময়ী বক্তব্য ও দৃঢ় মনোবল ছিল আব্বাসীয় শাসক হারুনের কাছে অসহনীয়। ইমাম মুসা ইবনে জাফর (আ.)’র অনুসারীদের সঙ্গে তাঁর সার্বক্ষণিক যোগাযোগের কথাও হারুন তার গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে জানতে পেরেছিল। হারুন এটাও বুঝতে পেরেছিল যে ইমাম যখনই উপযুক্ত সুযোগ পাবেন তখনই স্বয়ং বিপ্লব করবেন কিংবা তাঁর সঙ্গীদেরকে আন্দোলনের নির্দেশ দেবেন, ফলে তার হুকুমতের পতন হবে অনিবার্য। তাই হারুন বিষ প্রয়োগ করে আপোষহীন ৫৫ বছর বয়স্ক এই ইমামকে শহীদ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৩ হিজরির ২৫ রজব তিনি শাহাদত বরণ করেন।
ইমাম মুসা কাযিম (আ.)’র মহানুভবতা, প্রেমময় ইবাদত, নম্রতা, সহিষ্ণুতা, তত্ত্বীয় ও জ্ঞানগর্ভ বিতর্কে ইমামের ঐশী জ্ঞান এবং দানশীলতা ছিল শিয়া ও সুন্নিসহ সবার কাছে এমনকি তাঁর শত্রুদের কাছেও সুবিদিত। তত্ত্বীয় ও জ্ঞানগর্ভ বিতর্কে ইমামের ঐশী জ্ঞান, বিস্তৃত চিন্তাশক্তি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর পরিপূর্ণ দখল ফুটে উঠত। তিনি যে কোনো প্রশ্নের সঠিক, পরিপূর্ণ এবং প্রশ্নকারীর বোধগম্যতার আলোকে জবাব দিতেন। তাঁর প্রেমময় ইবাদত ছিল সাধকদের জন্য আদর্শ।
মদিনার অধিবাসীরা ইমাম মুসা কাযিম (আ.)-কে যাইনুল মুতাহাজ্জেদীন অর্থাৎ রাত্রি জাগরণকারীদের সৌন্দর্য উপাধিতে ভূষিত করেছিল। এই মহান ইমাম এত সুন্দর ও সুললিত কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতেন যে, যে কেউ তা শুনে কেঁদে ফেলত।
বিশিষ্ট সুন্নি ব্যক্তিত্বরাও নবী-বংশের এই মহান ইমামের প্রতি শ্রদ্ধা করতেন ও মহানবীর (সা) আহলেবাইতের অনুসারীদের মতই তাঁর পবিত্র মাজার জিয়ারত করতেন। ইমাম মুসা কাযিমের মাজার বাগদাদের উত্তরে কাযিমাইন এলাকায় অবস্থিত। তাঁর মাজারের সঙ্গেই রয়েছে নাতি ইমাম জাওয়াদেরও (আ) মাজার। হারামে কাযিমাইন নামে খ্যাত এই দুই মাজার জিয়ারত করতে আসেন বিশ্বের নানা অঞ্চলের শিয়া ও সুন্নি মুসলমানরা।
এবারে এই মহামানবের কয়েকটি স্মরণীয় বাণী ও উপদেশ তুলে ধরছি:
১. আল্লাহর প্রকৃত বান্দাহ বা দাস তাঁরাই যারা মানুষের নানা সমস্যা সমাধানে বা অভাব দূর করতে সচেষ্ট। কিয়ামতের দিন তাঁরা নিরাপদ থাকবেন। (সূত্র: ওয়াসায়েলুশ শিয়া)
২. মানুষের প্রজ্ঞা বা জ্ঞান রয়েছে চারটি বিষয়ে: ১. প্রতিপালককে চেনার মধ্যে ২. তোমার সঙ্গে ও তোমার জন্য কি করা হয়েছে তা জানা ৩. এটা জানা যে তোমাকে কি করতে বলা হয়েছে ও ৪. এটা জানা যে কোন কোন বিষয় তোমাকে ধর্ম থেকে বের করে দেয়। (কাশফুল গাম্মাহ)
৩. আল্লাহর মনোনীত দ্বীন বা ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন কর, আর এ বিষয়ে তথ্য ও বিধি-বিধানের জ্ঞান অর্জন হচ্ছে প্রজ্ঞার (তথা অন্তর্দৃষ্টি, দূরদৃষ্টি ইত্যাদি) চাবি ও ইবাদাতের পূর্ণতা। (মুসনাদে ইমাম কাযিম-আ.)
৪. পৃথিবীর দৃষ্টান্ত হচ্ছে দরিয়ার নোনা পানির মত, এর পানি যতই পান করা হোক না কেন তাতে তৃষ্ণা কমে না বরং বেড়ে যায় যতক্ষণ না এই পানি পান তার মৃত্যু ঘটায়। (বিহারুল আনোয়ার)
৫. ধৈর্যশীল মানুষের জন্য মুসিবত বা বিপদ একটি, কিন্তু অধৈর্যশীল মানুষের জন্য আরও একটি বিপদ যুক্ত হয়। (প্রাগুক্ত)
৬. গোপনেও (পাপ করতে) আল্লাহকে লজ্জা কর যেভাবে প্রকাশ্যে আমরা মানুষের সামনে মন্দ কিছু করতে আমরা লজ্জা পাই। (তোহফা আল উকুল)
৭. নিশ্চয়ই মানুষের ওপর আল্লাহর জন্য রয়েছে দুটি হুজ্জাত (প্রমাণ) বাহ্যিক হুজ্জাত আর অভ্যন্তরীণ হুজ্জাত বা নিদর্শন। বাহ্যিক হুজ্জাত হল রসুল, নবী ও ইমামগণ আর অভ্যন্তরীণ হুজ্জাত হল বিবেকসমূহ। (উসুলে কাফি) #
পার্সটুডে/