
গল্প শুরু হয় একটি রহস্যময় ভাইরাসের মাধ্যমে। রাতারাতি পৃথিবীর প্রায় সব মানুষ একটি ‘মনের সমষ্টি’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ফলে কোনো দুঃখ নেই, কোনো মতভেদ নেই, কোনো বিরোধ নেই। সবাই একই রকম হাসে, একই রকম ভাবে, একই রকম ‘সুখী’। কিন্তু এই কৃত্রিম সুখের জগতে কয়েকজন ব্যক্তি — যাদের মধ্যে প্রধান চরিত্র ক্যারল — এখনো সংযোগের বাইরে থেকে যায় এবং নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে লড়াই করে।
ইকনা’র বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, «প্লুরিবাস» আসলে এক গভীর দার্শনিক ও ধর্মীয় প্রশ্ন তুলে ধরেছে: যখন মানুষের থেকে পছন্দের স্বাধীনতা ও দায়িত্ব কেড়ে নেওয়া হয়, তখন কি তার ‘মানুষ’ হিসেবে থাকার কোনো অর্থ থাকে?
সিরিজটি কুরআনের বেশ কয়েকটি আয়াতের আলোকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা যায়:
১. মানুষ: পছন্দের জন্য সৃষ্টি সিরিজে প্রায় সবাই একটি মনের সমষ্টিতে মিশে যায়, যেখানে মতভেদ মুছে ফেলা হয় এবং সবাইকে একই ধরনের কৃত্রিম সুখ দেওয়া হয়। কিন্তু এটি সরাসরি স্মরণ করিয়ে দেয় কুরআনের সেই আয়াতকে যা ব্যক্তিগত দায়িত্বের ওপর জোর দেয়: «كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ رَهِينَةٌ» (সূরা আল-মুদ্দাসসির: ৩৮) “প্রতিটি আত্মা তার নিজের কর্মের জিম্মি।” যখন মানুষের থেকে পছন্দ কেড়ে নেওয়া হয়, তখন সে নিজেকেও হারিয়ে ফেলে।
২. কষ্ট ছাড়া সুখ: পরিপূর্ণতা না প্রতারণা? ‘জনতা’ সুখের প্রতিশ্রুতি দেয় — কোনো ব্যথা নেই, কোনো সংঘাত নেই। কিন্তু কুরআন বলে: «لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي كَبَدٍ» (সূরা আল-বালাদ: ৪) “আমি মানুষকে কষ্টের মধ্যে সৃষ্টি করেছি।” সিরিজ স্পষ্টভাবে দেখায়: কষ্ট যদি সরিয়ে ফেলা হয়, তাহলে মানুষের বেড়ে ওঠা ও পরিণত হওয়াও বন্ধ হয়ে যায়।
৩. ‘আত্মা’র বিলুপ্তি: দায়িত্বের অবসান প্লুরিবাসের জগতে মানুষের মন এতটাই একে অপরের মধ্যে মিশে যায় যে, কুরআনী অর্থে ‘নাফস’ (স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, ইচ্ছাশক্তি, দায়বদ্ধতা) সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যায়। আর যেখানে আত্মা হারায়, সেখানে দায়িত্বও আর থাকে না। এটিই সেই বিপদ যার বিরুদ্ধে কুরআন বারবার সতর্ক করেছে: অন্ধ অনুসরণ, চিন্তাহীন সমষ্টিবাদ, বিনা প্রশ্নে আনুগত্য।
নির্মাণগত দিক থেকে সিরিজটি অসাধারণ। এটি পুরোপুরি ভবিষ্যৎ-কেন্দ্রিক নয়, আজকের দুনিয়ার মতোও নয়; বরং এক অস্পষ্ট মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। এই দূরত্বই গল্পকে রূপকের মাত্রা দিয়েছে। মিনিমাল সেট ডিজাইন, ঠান্ডা আলোকসজ্জা এবং বন্ধ ক্যামেরা ফ্রেম দর্শকের মনে শ্বাসরুদ্ধকর নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি জাগায় — যেন চরিত্রগুলো সবসময় কোনো অদৃশ্য নজরের নিচে আছে।
সিরিজটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, মনস্তাত্ত্বিক নাটক এবং কালো হাস্যরসের অসাধারণ মিশ্রণ। যারা শুধু বিনোদন নয়, গভীর চিন্তার খোঁজে থাকেন, তাদের জন্য এটি এক অবিস্মরণীয় কাজ।
কিছু সমালোচক মনে করেন মাঝের পর্বগুলোতে গতি কিছুটা ধীর হয়ে গেছে এবং কিছু জটিলতা স্পষ্ট সমাধান ছাড়াই শুধু তথ্যের ভার বাড়িয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে «প্লুরিবাস» এমন একটি সিরিজ যা দেখার পর দর্শককে নিজের বাস্তবতা নিয়েই সন্দেহে ফেলে দেয়।
সিরিজের চূড়ান্ত বার্তা: যে পৃথিবীতে কেউ আর “আমি” বলার সাহস রাখে না, সেখানে মানবতা নিঃশব্দে মৃত্যুবরণ করে। আর যে এখনো “আমি” বলতে পারে, তার কণ্ঠই একমাত্র জীবন্ত শব্দ হয়ে থাকে। 4320548#
