IQNA

ফ্রান্সে হালাল পণ্যের উত্পাদন: চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে

17:56 - October 27, 2025
সংবাদ: 3478328
ইকনা- ফ্রান্স ও ইউরোপে হালাল খাদ্যের ইতিহাস বহু পুরনো। বছরের পর বছর ধরে এটি শুধু ধর্মীয় খাদ্য নয়, বরং অর্থনীতি ও রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
আলজাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফ্রান্সে ইসলামি ধর্মীয় অনুশীলন করা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। মসজিদে নামাজ আদায় করা নানা কারণে জটিল, হিজাব পরা আইনত অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়, যার ফলে মুসলিম নারীরা চাকরি, সন্তানকে স্কুলে নেওয়া কিংবা খেলাধুলার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। ইসলামী স্কুলগুলোর বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে; অল্প কিছু বেঁচে আছে, সেগুলোরও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
এই পরিস্থিতির মধ্যেও যে একটি ক্ষেত্র ক্রমবর্ধমান, সেটি হলো হালাল খাদ্য।
দেশজুড়ে হালাল মাংস এখন সাধারণ বাজার ও কসাইখানার অন্যান্য মাংসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। রেস্টুরেন্টগুলো—সস্তা থেকে দামি—সবখানেই হালাল খাবার পাওয়া যাচ্ছে। তুলনামূলকভাবে সস্তা ও গুণগতমানসম্পন্ন হওয়ায় রেস্টুরেন্ট মালিকরাও এটি পরিবেশন শুরু করেছেন।
ফ্রান্সে হালাল শুধু খাবারের বিষয় নয়; এটি রাজনৈতিক বিতর্ক, অর্থনৈতিক লেনদেন ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট চেইন “কুইক” তাদের মেনুতে পুরোপুরি হালাল মাংস ব্যবহার শুরু করেছে। বিশেষত ইসলামি উৎসবগুলোতে এর চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
হালাল খাদ্যের বিকাশ ও অর্থনৈতিক ভূমিকা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ১৯৬০-এর দশকে মুসলিম দেশ—বিশেষত আলজেরিয়া ও মরক্কো—থেকে অভিবাসীদের আগমনের সঙ্গে ফ্রান্সে হালাল খাদ্যের বাজার তৈরি হয়। প্রথমদিকে এই বাজার সীমিত ছিল, কিন্তু গত তিন দশকে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।
১৯৯০-এর দশকে মুসলিম ভোক্তারা তাঁদের খাদ্য নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠেন। জীবনমান উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মাংসের ব্যবহার বেড়ে যায়। এক সময় শুধুমাত্র উৎসবের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত মাংস এখন মুসলিম পরিবারের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকার অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে।
পাশাপাশি, “ম্যাড কাউ ডিজিজ” ও “ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ”-এর মতো রোগের কারণে মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত ও ইসলামী নিয়মে জবাই করা মাংসের দিকে ঝুঁকেছেন। এর ফলে হালাল শিল্প একটি স্বতন্ত্র খাতে রূপ নেয়, যেখানে শত শত প্রতিষ্ঠান হালাল সার্টিফিকেট প্রদান করছে।
রাজনীতি ও হালাল ইস্যু
২০১২ সালের ফরাসি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রথমবারের মতো “হালাল” রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে আসে। কেউ কেউ একে “জাতিগত পণ্য” হিসেবে দেখান এবং দাবি করেন যে এটি ফরাসি ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমনকি কেউ কেউ হালাল খাদ্যকে ফরাসি সমাজে জাতীয় পরিচয়ের জন্য হুমকি বলেও আখ্যা দেন।
অন্যদিকে, মুসলিম তরুণ প্রজন্ম হালাল খাবারকে তাঁদের ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত পছন্দের অংশ হিসেবে দেখে—যা ফরাসি নাগরিকত্বের পরিপন্থী নয়। বরং তাঁরা মনে করেন এটি তাঁদের আত্মপরিচয়ের প্রতিফলন।
সরকারি বিধিনিষেধ ও সংকট
২০২০ সালের নভেম্বরে ফ্রান্সের কৃষি মন্ত্রণালয় পোলট্রি জবাইয়ের নতুন নিয়ম প্রণয়ন করে, যেখানে জোরালো বিদ্যুৎ-শক ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়। মুসলিম সংগঠনগুলো এটি ইসলামী জবাই পদ্ধতির বিরুদ্ধে পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা হিসেবে দেখেছে।
তিনটি প্রধান মসজিদ—প্যারিস, লিয়ন ও ইভরির মসজিদ—এই নীতির বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। পর্যবেক্ষকদের মতে, এটি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ সরকারের মুসলিমবিরোধী নীতির আরেকটি অধ্যায়।
অর্থনৈতিক দিক
২০১৬ সালে ফরাসি দৈনিক ল্য মন্ড জানায়, ফ্রান্সের হালাল বাজারের মূল্য প্রায় ৫.৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালের বিএফএম টিভি জানায়, বড় দোকানগুলোতে হালাল পণ্যের বিক্রি বাড়লেও সামগ্রিক বৃদ্ধি এখনো সীমিত।
বর্তমানে হালাল পণ্য দেশের মোট ভোগ্যপণ্যের মাত্র ০.৩% দখল করে—যা কারুশিল্পজাত বিয়ার বিক্রির সমান।
তবু, ছোট হালাল কোম্পানিগুলো এই বাজারে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, “ইসলা ডেলিস”, ১৯৯০ সালে দুই ফরাসি ইহুদি উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠিত একটি কোম্পানি, এখন ফ্রান্সের বড় সুপারমার্কেটগুলোর হালাল মাংসের প্রায় অর্ধেক সরবরাহ করে।
যদিও ২০১৮ সালে এটি একটি ব্রিটিশ বিনিয়োগ ফান্ডের কাছে ৮০ মিলিয়ন ইউরোতে বিক্রি হয়, তবুও বাজারে প্রচলিত, ছোট কসাইখানাগুলোই ৮৫% হালাল মাংস সরবরাহ করছে।
উপসংহার
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফ্রান্সে হালাল বাজারের প্রবৃদ্ধি স্থির হলেও লাভজনক। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে হালাল পণ্যের বিক্রি দুই গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং প্রতিবছর ৮–১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
তবু কঠোর সরকারি নীতিমালা ও সামাজিক চাপের কারণে, ফ্রান্সে হালাল শিল্পকে একদিকে আর্থিক সাফল্যের প্রতীক, অন্যদিকে ধর্মীয় সীমাবদ্ধতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। 4311778#
 
captcha