IQNA

ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি

0:02 - April 11, 2020
সংবাদ: 2610574
তেহরান (ইকনা)- প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পরও সরকারি চাল বিতরণে অনিয়ম দুর্নীতি থামছে না। প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো জেলা-উপজেলায় এবং ইউনিয়নে সরকারি ত্রাণের চাল বিতরণে অনিয়ম-দুর্নীত এবং আত্মসাতৎ ঘটনা ঘটছে। সারাদেশে ৯ দিনে অন্তত ২ হাজার ২৬৪ বস্তা সরকারি ত্রাণের চাল চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ৩০ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ৯ দিনের ব্যবধানে এই চাল চুরির ঘটনাগুলো ঘটে।

স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও স্থানীয় গণমাধ্যকর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, এ পর্যন্ত পাথরঘাটা উপজেলায় ৫৫০ বস্তা, বগুড়ায় ১০০ বস্তা, নাটোরে ১৩ বস্তা, জয়পুরহাটে ৭ বস্তা, যশোর ৮০ বস্তা, যশোরের মণিরামপুরে ৫৫৫ বস্তা, ঝিকরগাছায় ১ বস্তা, নওগাঁয় ৩৩৮ বস্তা, বাগেরহাটে ১৮ বস্তা, পটুয়াখালীতে ১০ বস্তা, ঝালকাঠিতে ৫০ বস্তা, সিলেটে ১২৫ বস্তা, ময়মনসিংহের ত্রিশালে ১৬ বস্তা, সারিয়াকান্দি উপজেলায় ২৮৮ বস্তা, বগুড়ার গাবতলী উপজেলায় ১০০ বস্তা এবং শিবগঞ্জ ১৩ বস্তা চাল চুরির তথ্য পাওয়া গেছে। করোনা সংক্রমণের দেশের এই দুর্যোগ মুহূর্তে ত্রাণের চাল চুরির ঘটনায় বিপাকে পড়েছে হতদরিদ্র মানুষ।

কর্মহীন নিম্নআয়ের এবং দরিদ্র তিন কোটি ৮৫ হাজার মানুষকে বিশেষ ত্রাণ সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার। এ জন্য জেলা প্রশাসকদেরকে তালিকা তৈরী করতে বলা হয়েছে। কিন্তু সেই তালিকা এখনো সম্পন্ন করতে পারেননি জেলা প্রশাসকরা। তাদের অভিযোগ, স্থানীয় এমপি এবং উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের দ্ব›েদ্বর কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত দেশের ৬৪ জেলায় ৬৫ হাজার ৯৭৬ মে:টন এবং নগদ ২৫ কোটি ৩১ লাখ ৭২ হাজার ২৭৪ টাকা এবং শিশু খাদ্যেও জন্য ৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা ডিসিদের অনুকুলে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই বরাদ্দ নিয়ে স্থানীয় এমপি ও উপজেলার চেয়ারম্যানদের দ্ব›েদ্ব বাড়ছে। কেউ তালিকা দিচ্ছে আবার তালিকা বাতিল করা হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিসিদের কয়েজন বলেছেন এরকম তালিকা দিয়ে ত্রাণ বিতরণ ঠিক হবে না। কারণ দলীয়ভাবে অনেক মধ্যবিত্ত এবং মাঝারি কৃষককেও তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। অথচ এদের অনেকেই তালিকায় থাকতে চান না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা: এনামুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, আমরা সারাদেশে ২৯ লাখ ৭৫ হাজার পরিবারের তালিকা করতে পেরেছি। প্রতি পরিবারে চারজন করে সদস্য ধরা হলে ১ কোটি ২০ লাখ লোকের তালিকা হয়েছে। এখনো প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ লোক তালিকার বাইরে আছে। একেবারে গ্রামের ওয়ার্ড পর্যায়ের তালিকা তৈরি বেশ কঠিন। সেজন্য কিছুটা সময় লাগছে। তবে একদিকে তালিকা তৈরির কাজ চলছে, একইসাথে ত্রাণ বিতরণও করা হচ্ছে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে এই তালিকা করে ঘরে ঘরে চাল পৌঁছে দেয়া হচ্ছে এবং এখানে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই।

মানুষের দুর্ভোগের সময় ত্রাণ নিয়ে কেউ দুর্নীতি করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে, তাকে কিন্তু আমি ছাড়বো না বলে ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করে সরকারি চাল লোপাট করতে গিয়ে নাটোর, বগুড়া, জয়পুরহাট, সাতক্ষীরা ও যশোর কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা।

খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম ইনকিলাবকে বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ২ হাজার ৪ শত ৯০ মে.টন ওএমএস চাল দিয়েছি। আর যে এলাকায় বিতরণে অনিয়ম পেয়েছি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যেগুলো ধরা পড়ছে সেগুলো ওএমএসের চাল নয়। কারণ বিভিন্ন বাহিনীর রেশনের চালগুলো বাজারে বিক্রি হচ্ছে। তাদেরও একই ধরনের বস্তা।

হতদরিদ্রদের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে যে চাল দেয়া হচ্ছে, সেই চাল নিয়ে দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতার জেল-জরিমানা হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
জানা গেছে বগুড়ায় ১০ টাকা কেজি দরের চাল নিয়ে মহিষাবান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ওয়াজেদ হোসেন এবং কুতুবপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজিউল হকের বিরুদ্ধে অনিয়মের মামলা করা হয়েছে।

এ দিকে বগুড়ার জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহম্মাদ ইনকিলাবকে বলেন, আমার জেলায় ৮৪২ মে.টন সরকারি ত্রাণ বিরতণ করেছি। এখানে তেমন অনিয়ম হয়নি। তবে ওএমএস বিতরণে একটি অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। সেই ব্যবসীয় এবং ডিলারকে গ্রফতার করা হয়েছে।

রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান ইনকিলাবকে বলেন, যেখানে ত্রাণ ও ওমএস চাল বিরতণে অনিয়ম অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অনেক সময় তালিকা ছাড়া ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে।
এদিকে ঝালকাঠিঝালকাঠি সদর উপজেলার ৮ নং বাসন্ডা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মনিরুজ্জামান মনিরের আগরবাড়ি গ্রামের বাড়ি থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের আড়াই টন ত্রাণের চাল উদ্ধারের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।

বগুড়া ব্যুরো জানান : বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নে এক চাল ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে ৪০ বস্তা ভিজিডির চাল উদ্ধার করেছে পুলিশ। মহিলা অধিদফতর থেকে দুস্থদের জন্য বরাদ্দের চাল বিতরণ না করে তা মিঠু মিয়া নামের এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে মর্মে খবর আসে পুলিশের কাছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে মিঠু মিয়ার বাড়িতে অভিযান চালায় সোনাতলা থানা পুলিশ। অভিযানকালে ৪০ বস্তা চালসহ হাতে নাতে ধরা পড়ে মিঠু।

সোনাতলা উপজেলার নির্বাহী অফিসার শফিকুর আলম এবং মধুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অসিম কুমার জৈন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। পুলিশ এ ব্যাপারে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
ঠাকুরগাঁও জেলা সংবাদদাতা জানান : ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় হতদরিদ্রের জন্য ওএমএস ও ভিজিডির বরাদ্দকৃত ৮৮৯ বস্তা চাল জব্দ করেছে প্রশাসন। এ সময় দুটি হাস্কিং মিলের ৪টি গুদাম সিলগালা করে দেয়া হয়।

বৃহস্পতিবার দুপুরে বালিয়াডাঙ্গীর কুশলডাঙ্গী বাজারে ভাই ভাই হাস্কিং মিলে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খায়রুল আলম সুমন এসব চাল জব্দ করেন।
অভিযানে মিলের ৪টি গুদাম থেকে ৮২১ বস্তা চাল জব্দ করেন তিনি। পরে গুদাম চারটি সিলগালা করে দেন। অভিযানের সংবাদ পেয়ে আগেই সটকে পরেন মিলের এক মালিক আমিরুল ইসলাম। তবে তার ভাই জমিরুল ইসলাম (৪০) কে গ্রেফতার করে পুলিশ। অপরদিকে ওইদিন সকালে একই উপজেলার বড় পলাশবাড়ি ইউনিয়নের পারুয়া গ্রাম থেকে আরো ৬৮বস্তা চাল আটক করা হয়। এসময় চাল বহনকারি নসিমন চালক পান্না কাউসার (৩০) কে আটক করে পুলিশ।

মাদারীপুর জেলা সংবাদদাতা জানান : মাদারীপুরের শিবচর পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব শ্যামাইল এলাকায় গত বৃহস্পতিবার সকালে ত্রাণ বিতরণের তালিকা তৈরি করাকে কেন্দ্র করে দুই গ্রæপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে তিন জন আহত হয়েছে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করার জন্য শিবচর পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আজিজুল হক শেখ একই এলাকার যুবক খালেক কাজী ও নজরুল শেখকে তাদের দুই বংশের ত্রাণের জন্য সুবিধাভোগীদের তালিকা তৈরির দায়িত্ব দেন। নজরুল শেখের সাথে ওই তালিকা তৈরি নিয়ে খালেক কাজীর ভাই সাহাবুদ্দিন কাজীর কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে নজরুল শেখ তার বংশের হিরু শেখ, আফতাব শেখ, সুর্য শেখ ও মহসীনকে নিয়ে সাহাবুদ্দিন কাজীকে বেদম মারপিট করে। এসময় তার চিৎকারে তার ভাই হৃদয় ও আরিফ এগিয়ে আসলে তাদেরও মারপিট করা হয়। পরে এলাকাবাসী তাদের উদ্ধার করে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে।

শেরপুর জেলা সংবাদদাতা জানান : শেরপুরে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির ৩৩ বস্তা চাল আটক করেছে উপজেলা প্রশাসন। গতরাতে সদর উপজেলার পোড়ার দোকান এলাকার চরপক্ষীমারী ইউনিয়নের চৌকিদার জহুরুল হকের বাড়ি থেকে এ চাল উদ্ধার করা হয়। চাল উদ্ধারের পর থেকে ওই চৌকিদার পলাতক রয়েছেন।
উপজেলা প্রশাসন এ বিষয়ে উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা মামুন হোসেনকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন। বিষয়টি খাদ্য অফিসের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা মামুন হোসেন। এ বিষয়ে ওই চৌকিদারের মোবাইলে ফোন করলে তার ছেলে পরিচয় দিয়ে একজন বলেন, কোন এক মানিক ওই চাল তাদের বাড়িতে রেখে গেছিল।

সূত্র: dailyinqilab

captcha