IQNA

পোল্যান্ডে মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাস

0:02 - August 04, 2022
সংবাদ: 3472233
তেহরান (ইকনা): তাতার মুসলিমরাই মধ্য ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মীয় সংখ্যালঘু। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতক থেকে ইউরোপীয় ইতিহাসের অংশ। তাতার মুসলিমরা প্রথম ‘পোলিশ-লিথুনিয়া’ যুক্তরাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করে এবং কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত পোল্যান্ডকে রক্ষায় বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ধীরে তারা পোলিশ সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।
মুসলিম আগমন : পোল্যান্ডে মুসলমানের আগমন ঘটে খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকে। তখন পোল্যান্ড ও লিথুনিয়া অভিন্ন শাসকের অধীনে ছিল। মুসলিমরা মধ্য এশিয়ার গোল্ডেন হর্ড থেকে আগমন করেছিল এবং তারা ছিল তাতার বংশোদ্ভূত। তারা প্রথমে যুদ্ধবন্দি ও রাজনৈতিক উদ্বাস্তু হিসেবে পোল্যান্ডে এলেও পোল্যান্ডকেই মাতৃভূমি হিসেবে গ্রহণ করে। লিথুনিয়ার মহান শাসক ভিটাউটাস দ্য গ্রেট (১৪০১-৪০ খ্রি.) সর্বপ্রথম তাদের ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের পাশাপাশি অন্য মুসলিম তাতারদেরও আশ্রয় দেন তিনি। যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তিনি তাদের কৃষিভূমি দান করেন। এ সময় তাদের কেউ কেউ ‘বয়ার্স’দের সমান সামাজিক মর্যাদা লাভ করেন। রাজপুত্রদের পরই ছিল অভিজাত বয়ার্সদের অবস্থান।
 
অন্যদিকে মুসলিমরাও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। তারা সম্রাট ভিটাউটাসের উদ্দেশে বলে, ‘আমরা আমাদের তরবারির শপথ করে বলছি, আমরা লিথুনিয়ানদের ভালোবাসি। যখন আমরা তাদের কাছে যুদ্ধবন্দি হিসেবে ছিলাম এবং যখন আমরা এই ভূমিতে প্রবেশ করি, তখন তারা বলেছিল এই বালু, এই পানি এবং এই বৃক্ষরাজি আমাদের সবার। আমরা আপনার দেশে ভিন্নদেশি নই। ’ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত মুসলিমদের সংখ্যা ২৫ হাজারে উন্নীত হয়। ১৬৭৯ সালে রাজা তৃতীয় জন সবেইস্কি পোডলাসিয়ায় মুসলিমদের ভূমি দান করেন। এর মাধ্যমেই মূলত আধুনিক পোল্যান্ডে মুসলিমদের বসবাস শুরু হয়।
 
পোলিশ মুসলিমদের বীরত্বগাথা : মুসলিমরা কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত পোলিশ-লিথুনিয়া বাহিনীর অংশ হয়েছিল। এমনকি মুসলিম তাতারদের নিয়ে একটি স্বতন্ত্র অশ্বারোহী ইউনিট গঠিত হয়েছিল। তারা ছিল সেনাবাহিনীর একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। এই ইউনিটের সদস্য ছিল এক শ থেকে দুই শ অশ্বারোহী সৈনিক। এই বিশেষ ইউনিটটি সরাসরি রাজা বা রাজপুত্রের অধীনে পরিচালিত হতো। সেনাবাহিনী ছাড়াও মুসলিমরা পুলিশ স্কোয়াডেও কাজ করত। সামরিক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সম্রাট নিজেও তাতার মুসলিমদের সাহসিকতা, দক্ষতা, প্রশিক্ষণ ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রশংসা করতেন।
 
পোল্যান্ডের মুসলিম তাতার ইউনিটটি পোলিশ-লিথুনিয়া বাহিনীর সব গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ও সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেছে। যেমন—গ্রুনওয়াল্ডের যুদ্ধ (১৪১০ খ্রি.), পোলিশ-টিউটনিক যুদ্ধ (১৫১৯-২১ খ্রি.)। পোলিশ-লিথুনিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও ভয়াবহ একটি যুদ্ধ ছিল জেরুজালেমের সেন্ট মেরিজ হসপিটালের ‘অর্ডার অব দ্য টিউটনিক নাইকস’-এর সঙ্গে যুদ্ধ। এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষ এই ঘোষণা দিয়ে ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের সমর্থন লাভ করেছিল যে পোলিশ-লিথুনিয়ায় তারা স্রষ্টায় অবিশ্বাসী পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ১৫ জুলাই ১৪১০ খ্রিস্টাব্দে পোলিশ-লিথুনিয়া বাহিনী তাদের পরাজিত করে এবং তাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে মুসলিম সৈন্যরা। তাদের সংখ্যা ছিল দুই হাজার।
 
পোল্যান্ডের রাজা প্রথম সিগিসমন্ড ১৫১৯-২০ খ্রিস্টাব্দে সেনাবাহিনীতে তাতার মুসলিমদের সংখ্যা তিন হাজারে উন্নীত করেন। এ ছাড়া তাতার মুসলিমরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ১৬৬০-৩ খ্রিস্টাব্দের এবং ১৭৯০ সালের স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিদ্রোহেও অংশগ্রহণ করে। ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ডে সোভিয়েত রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও মুসলিম অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল।
 
সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার : পোল্যান্ডে আগমনের শুরু থেকেই মুসলিমরা ধর্মপালন ও মসজিদ নির্মাণের স্বাধীনতা ভোগ করে আসছে। পোল্যান্ডে মুসলিম সমাজ ছিল মসজিদকেন্দ্রিক। একজন মোল্লা সামাজিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিতেন। মোল্লাদের নির্বাচন করতেন সম্প্রদায়ের আলেমরা। এসব মোল্লা শুধু মসজিদের নেতা ছিলেন না, বরং তাঁরা অফিস-আদালতে নিজ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করতেন, জন্ম ও মৃত্যুর হিসাব সংরক্ষণ করতেন এবং প্রাশাসনিক কাজের শপথ গ্রহণ করতেন।
 
ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ভূমির বিনিময়ে সেনা বাহিনীতে কর্মরত তাতার মুসলিমরা লিথুনিয়ান অভিজাত শ্রেণির সমমর্যাদাসম্পন্ন বলে গণ্য হতেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে মুসলিম তাতাররা আনুষ্ঠানিকভাবে অভিজাত শ্রেণির সব সামাজিক অধিকার লাভ করে। অষ্টদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্বে মুসলিমদের ভূমির মালিকানা অনুদান থেকে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে উন্নীত হয়। ৩ মে ১৭৯১ সালে অনুমোদিত সংবিধান মুসলিমদের পরিপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করে। কিন্তু ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া, প্রুশিয়া, হাবসবার্গ অস্ট্রিয়া কর্তৃক তৃতীয় বিভাজনের মাধ্যমে পোল্যান্ড স্বাধীনতা হারায় এবং বেশির ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
 
বর্তমানে মুসলমানের অবস্থা : ১৯১৮ সালে পোল্যান্ড স্বাধীন হওয়ার পর মুসলিমরা আগের মতোই স্বাধীনতা লাভ করে। তবে পোল্যান্ডের সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তাদের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। তখন পোল্যান্ড-লিথুনিয়ায় ভূমির স্বত্বাধিকারী মুসলমানের সংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার। ১৯২৫ সালে পোল্যান্ডের স্বরাষ্ট্র, ধর্ম ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় যৌথ উদ্যোগে দেশটির সব প্রতিনিধিত্বশীল মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে কথা বলে এবং ‘মুসলিম রিলিজিয়াস ইউনিয়ন’ (এমজেডআর) গঠন করে। এমজেডআরের সঙ্গে কয়েক বছরের ধারাবাহিক আলোচনার পর সরকার ২১ এপ্রিল ১৯৩৬ সালে আইন পাস করার মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করে। আইনে এমজেডআর পরিচালনার নীতিও নির্ধারণ করে দেওয়া হয় এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধানের মর্যাদা অন্য রাষ্ট্রস্বীকৃত ধর্মের নেতৃত্বদানকারীদের সমান ঘোষণা করা হয়।
 
এই আইনের অধীনে মুসলিমরা মুসলিম রাষ্ট্রীয় অনুদান লাভ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করার অধিকার, সম্পদ ওয়াকফ করার সুযোগ, সেনাবাহিনী ও হাসপাতালে মুসলিম ধর্মগুরু নিয়োগ, বিচারক পদমর্যাদায় মুফতি নিয়োগের অধিকার লাভ করে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মুসলিম অধুষ্যিত আরো অঞ্চল পোল্যান্ডের মানচিত্রের বাইরে চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে ‘রিপাবলিক অব পোল্যান্ড’ গঠিত হয়। ১৯৮৯ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট শাসনের পতন ঘটে। এরপর অন্য নাগরিকদের মতো পোলিশ মুসলিমরাও তাদের ধর্মচর্চা ও রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পায়।
 
তবে কোনো সন্দেহ নেই, বর্তমানে পোল্যান্ডে মুসলিমরা একটি ছোট ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মাত্র। ২০০২ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে এবং এমজেডআরের তথ্যমতে পোল্যান্ডে স্থানীয় মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ৫১২৩ জন। এর বাইরে ছিল ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার অভিবাসী মুসলিম। ধারণা করা হয়, বর্তমানে মুসলমানের সংখ্যা ৫০ হাজার অতিক্রম করেছে।
 
তথ্যঋণ : ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারশের অধ্যাপক আগাতা এস. নালবোরস্কিকের প্রবন্ধ ‘দ্য পলিটিক্যাল পার্টিসিপেশন অব পোলিশ মুসলিম’ ও তুর্কি সংবাদ মাধ্যম আনাদুলু এজেন্সি
captcha