IQNA

হারানো ইহুদি কবিলা থেকে আফ্রিকায় জাল বংশতালিকা নির্মাণের রাজনীতি

4:40 - December 23, 2025
সংবাদ: 3478654
ইকনা- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে কিছু ইংরেজি ও সোয়াহিলি ভাষার মিডিয়ায় আফ্রিকার জাতি ও কবিলার সাথে ইসরায়েলের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক বা রক্তের সম্পর্ক স্থাপনের একটি বয়ানের প্রসার লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

হারানো ইহুদি কবিলা থেকে আফ্রিকায় জাল বংশতালিকা নির্মাণের রাজনীতি

তানজানিয়ায় ইরানের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা ও আফ্রিকা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মোহসেন মা’রেফি ইকনার জন্য প্রদত্ত এক নোটে লিখেছেন: এই বয়ানগুলো— যা কখনো ধর্মীয় ভাষায়, কখনো ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়— দাবি করে যে, আফ্রিকানদের বড় অংশ “ইয়াকুবের সন্তান” বা “হারানো বনি ইসরাইল কবিলা”।

এই প্রচেষ্টাগুলোর কোনো প্রামাণ্য ইহুদি ঐতিহ্যে ভিত্তি নেই, কোনো নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক পটভূমি নেই; বরং এগুলো আফ্রিকা মহাদেশে দখলদার কুদস শাসকগোষ্ঠীর প্রতি কৃত্রিম সহানুভূতি সৃষ্টির রাজনৈতিক-প্রচারণামূলক প্রকল্প।

ইহুদি ঐতিহ্যে আফ্রিকা-ইসরায়েল সম্পর্কের অনুসন্ধান “দশটি হারানো বনি ইসরাইল কবিলা” ধারণার মূল তালমুদিক ও মিদরাশি গ্রন্থে। এই কবিলাগুলো উত্তর ইসরাইল রাজ্যের পতনের পর দূরবর্তী অঞ্চলে নির্বাসিত হয় এবং ফিরে আসেনি। কিছু গ্রন্থে কিংবদন্তি সামবাতিয়ন নদীর উল্লেখ আছে যার ওপারে এই কবিলা বাস করে।

কিছু আধুনিক ও অপ্রামাণ্য ব্যাখ্যায় এটিকে ইথিওপিয়া, সুদান বা দক্ষিণের অঞ্চলের সাথে যুক্ত করা হয়েছে এবং ইসরায়েলপন্থী মিডিয়ায় এটি পুরো “আফ্রিকা”তে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে— যাতে ধর্মীয়-রাজনৈতিক সমর্থনের ভিত্তিতে কৃত্রিম সহানুভূতি তৈরি করা যায়। অথচ প্রামাণ্য ইহুদি গ্রন্থে আফ্রিকাকে এই কবিলার অবস্থান বলে কোনো স্পষ্ট উল্লেখ নেই এবং অনেক মহান রাব্বি সামবাতিয়ন নদীকে প্রতীকী-ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা বলে মনে করেন।

এরপরও ইসরায়েলপন্থী সাহিত্যে দুটি আফ্রিকান গোষ্ঠী বিশেষভাবে উল্লেখিত: লেম্বা কবিলা (জিম্বাবুয়ে, জাম্বিয়া, উত্তর দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিক) এবং ইথিওপিয়ার বেতা ইসরাইল। লেম্বাদের গল্পকে বাইবেলের একটি কাহিনীর সাথে যুক্ত করা হয় এবং জেনেটিক প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে— যা বিশ্বস্ত বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় গ্রহণ করেনি।

এই বংশতালিকা লেম্বা ও বেতা ইসরাইলে সীমাবদ্ধ থাকেনি; সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েলি প্রচারণায় আফ্রিকার আরও কবিলাকে ইয়াকুবের পুত্রদের সাথে যুক্ত করা হচ্ছে— যাতে ঐতিহাসিক সম্পর্কের দাবিতে ইহুদি ও খ্রিস্টান ইসরায়েলপন্থীরা সুবিধা লাভ করতে পারে।

আফ্রিকায় ইসরায়েলি জাল বংশতালিকা নির্মাণের পেছনের রাজনীতি “আফ্রিকা-ইসরায়েল সম্পর্ক ইনস্টিটিউট”— যা শাসকগোষ্ঠীর সমর্থিত— তার হোমপেজে লিখেছে: আফ্রিকায় ৫৪টি দেশ রয়েছে যারা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে ইসরায়েলকে সমর্থন করতে পারে। ইসরায়েল এমন উদ্যোগ নেতৃত্ব দিতে পারে যা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও পশ্চিমা দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াবে এবং ইরান ও তার মিত্রদের ক্ষতিকর প্রভাবের ভারসাম্য সৃষ্টি করবে।

অতএব, আফ্রিকায় ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় বংশতালিকা নির্মাণ নরম কৌশল যাতে দয়ালু ও জুলুমবিরোধী আফ্রিকানদের মধ্যে “ঐতিহাসিক আত্মীয়তা”র অনুভূতি তৈরি করে ইসরায়েলি নীতির প্রতি তাদের নৈতিক বিরোধিতা দুর্বল করা যায়। নিজেদের ও মিত্রদের প্রভাব বাড়ানো এবং ইসরায়েলের সাম্রাজ্যবাদ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামনের সারিতে থাকা ইরানের প্রভাব রোধ করা।

তানজানিয়া: নতুন কবিলা বংশতালিকার পরীক্ষাগার তানজানিয়া এই পদ্ধতির চরম উদাহরণ। কিছু ইহুদি-খ্রিস্টান প্রচারকের বয়ানে তানজানিয়ার প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ কবিলাকে ইয়াকুবের একেক পুত্রের সাথে যুক্ত করা হয়েছে: নিয়াকিউসা, ওয়াসাফওয়া, ওয়াকিঙ্গা— ইয়াহুদা; মাসাই, গোগো, হেহে, চাগা, মেরু— লেভি; নিয়িরাম্বা, জানাকি (তানজানিয়ার জাতির পিতা জুলিয়াস নায়েরেরের কবিলা)— ইউসুফ (আ.); মাকুয়া, মাকোন্দে, ওয়ামওয়েরা, ওয়ানদেনগেরেকো, ওয়াকুয়েরে, ওয়ালুগুরু, ওয়াকুতু— মানাস্সে; সুকুমা— রুবেন; ওয়াকুরিয়া— শিমউন; নিয়ামওয়েজি, ইয়াও— ইসসাখার; ওয়াশিরাজি, ওয়াজারামো, ওয়াজানজিবারি, ওয়াজিগুয়া, ওয়াদিগো— জাবুলুন; বেনা— বিনইয়ামিন; হাইয়া— গাদ; ওয়াপারে, ওয়াসামবা— আশের; এবং এনগোনি, ফিপা, এনগাতুরু, ওয়ারাঙ্গি, ওয়ামানগ’ারা, ওয়ামবুলু/ওয়াইরাঙ্গি— নাফতালি।

এই সম্পর্কগুলো— যা হাস্যকর— কখনো বাহ্যিক সাদৃশ্য বা নগণ্য মিলের ভিত্তিতে গড়া, যদিও এই কবিলাগুলোর ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি সুনথিবদ্ধ। সবচেয়ে অদ্ভুত উদাহরণ পূর্ব আফ্রিকার শিরাজি কবিলাকে জাবুলুনের সাথে যুক্ত করা। অথচ ঐতিহাসিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ দেখায় যে, শিরাজিরা ইরানের শিরাজ থেকে পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে হিজরত করেছেন এবং তাদের সংস্কৃতি, স্থাপত্য, নাম ও ধর্মীয় ঐতিহ্য স্পষ্টত ইরানি-ইসলামি। এই শিশুসুলভ যুক্তি: “জাবুলুন ইয়াকুবের পুত্র ছিলেন নাবিক এবং শিরাজিরাও দক্ষ নাবিক!”

এই সরলীকরণ আফ্রিকানদের কাছে প্রমাণ করে যে, লক্ষ্য কেবল প্রতীকী ও প্রচারণামূলক বয়ান তৈরি। এই শিশুসুলভ ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক বা রক্তের সম্পর্ক সৃষ্টির চেষ্টা বাস্তবে বিপরীত ফল দেয়। আফ্রিকান জাতিগুলোর স্বতন্ত্র ইতিহাস ও পরিচয়কে অবমূল্যায়ন করে জুলুমবিরোধীদের সাথে দখলদার ইসরায়েলের নৈতিক দূরত্ব আরও বাড়ায়। আজ অনেক আফ্রিকানের মনে ইসরায়েলের সাথে যেকোনো সম্পর্ক গর্বের নয় বরং তার রাজনৈতিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে লজ্জার বিষয়। এই বয়ান সমর্থন করে ইসরায়েল তার হারানো বৈধতা ফিরে পাবে না এবং শান্তিকামী আফ্রিকানদের মধ্যে স্থায়ী সহানুভূতি লাভ করতে পারবে না। যেখানে ইতিহাসকে রাজনীতির হাতিয়ার বানানো হয়েছে, সেখানে শিগগিরই তা তার স্রষ্টাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। 4323679#

captcha