IQNA

কেমন ছিল তারিক বিন জিয়াদের স্পেন

16:07 - November 24, 2022
সংবাদ: 3472875
তেহরান (ইকনা): স্পেনে মুসলিম শাসনের সূচনা করেছিলেন সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ। তিনিই ইউরোপ বিজয়ী প্রথম মুসলিম বীর।
কেমন ছিল তারিক বিন জিয়াদের স্পেন৭১০ খ্রিস্টাব্দের দিকে স্পেনের ক্ষমতায় আসেন রডেরিক। রডেরিক ক্ষমতায় এলে সিউটার শাসনকর্তা জুলিয়ান, প্রথানুযায়ী তাঁর কিশোরী কন্যাকে শিক্ষার্জনের জন্য রাজদরবারে পাঠান। রডেরিক জুলিয়ানের কন্যাকে ধর্ষণ করেন।
প্রতিশোধের নেশায় জুলিয়ান হাত মেলান মুসলিমদের সঙ্গে, আমন্ত্রণ জানান তারিক বিন জিয়াদকে। মুসলিমদের জিব্রাল্টা প্রণালী গোপনে পার করে দেওয়ার ব্যাপারে জুলিয়ান তারিকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন।
 
তারিকের বাহিনী ৭১১ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের সীমানায় অবতরণ করে। বর্তমানে যা জিব্রাল্টা নামে পরিচিত। আরবি ‘জাবাল আত তারিক’ থেকে উদ্ভব ‘তারিকের পাহাড়’। অর্থাৎ তারিকের নামানুসারেই জিব্রাল্টার নামকরণ।
 
জিব্রাল্টায় পৌঁছেই তারিক সব নৌযান পুড়িয়ে দেন। সৈন্যসংখ্যা সাত হাজার জন। স্পেন সম্রাট রডেরিক তারিকের মোকাবেলায় লক্ষাধিক সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন। রডেরিকের বিশাল সৈন্যবাহিনীকে মোকাবেলা করতে হবে শুনে তারিকের সৈন্যরা ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু তাদের ছিল অসীম সাহসী, প্রেরণাদায়ী নেতা—তারিক বিন জিয়াদ। সৈন্যদের উদ্দেশে যিনি বলেন : ‘...কোথায় তোমরা পালাবে? তোমাদের পেছনে সাগর, সামনে শত্রু...তোমরা বেঁচে থাকতে পারবে, যদি শত্রুর হাত থেকে নিজেদের জীবনকে ছিনিয়ে আনতে পার...। ” তারিকের মর্মস্পর্শী বক্তব্য স্পেন বিজয় সহজতর হয়, ৭১২ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে মুসলিম শাসন সুদৃঢ় হয়।
 
এরপর ১২৩৮ সালে মুহাম্মদ ইবনু নাসর গ্রানাডা জয় করেন। তিনি মাদ্রিদের ৪৩০ কিমি. দক্ষিণে দারু নদীর তীরে একটি প্রাসাদ নির্মাণের সূচনা ঘটান, নাম দেন আল হামরা। বলা হয়, ‘তাজমহল যদি হয় পৃথিবীর বুকে একটি গোলাপ, তবে আল হামরা হলো পৃথিবীর বুকে একটি গোলাপের বাগান। ’ আসলেই ‘শত পান্নার মধ্যে মুক্তা যেমন জ্বলজ্বল করে, তেমনি শত সবুজের মাঝে স্পেনের বুকে আল হামরা প্রাসাদ উজ্জ্বল হয়ে থাকে। ’
 
মুহাম্মদ ইবনু নাসর বিজয়ী বেশে গ্রানাডায় প্রবেশ করেন। তখন তাঁকে স্বাগত জানিয়ে সমবেত জনতার উল্লাস ধ্বনি ছিল মারহাবান লি-ল-নাসর অর্থাৎ ‘আল্লাহর কৃপায় বিজয়ীকে সুস্বাগত। ’ তিনি বলেছিলেন, ‘লা গালিবা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ ‘অন্য কেউ বিজয়ী না, যদি না আল্লাহ চান। ’ পরবর্তী সময়ে ‘লা গালিবা ইল্লাল্লাহ’ নাসরি বংশের স্লোগান হয়ে যায়। আল হামরার অলংকরণে এ বাক্যটি বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আল হামরার দেয়ালে দেয়ালে স্বর্ণ ও পাথরে খোদাই করা আরবি ক্যালিওগ্রাফির অনুপম শিল্প নিদর্শন অত্যন্ত বিস্ময়কর, দৃষ্টিনন্দন। পবিত্র কোরআন, হাদিস, আরবি কবিতা, উপদেশাবলি আল হামরার কক্ষ, খুঁটি, মিনার ইত্যাদিকে সুশোভিত করেছে। আল হামরার সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
 
২০ হাজার শ্রমিক প্রায় ৩৫ বছর পরিশ্রম করে আল হামরা নির্মাণ করেন।
 
আল হামরা নির্মাণশৈলীতে ব্যবহৃত হয়েছে দামেস্ক, আরব, গ্রিস, রোম, পারস্যের নানা নকশা ও স্থাপত্যকৌশল।
 
আল হামরায় ব্যবহৃত হয়েছে—
 
(ক) স্বর্ণ ১০০ মণ, (খ) রৌপ্য তিন হাজার মণ, (গ) মুক্তা ১৩ মণ, (ঘ) প্রচুর হিরা-পান্না, জহরত।
 
আল হামরার স্তম্ভ ১২৮টি। দরজা-জানালা সাত হাজার, এগুলো তৈরি হয়েছে মূল্যবান আবলুস কাঠে। আল হামরার দৈর্ঘ ৭৪০ মিটার (২,৪৩০ ফুট), প্রস্থ ২০৫ মিটার (৬৭০ ফুট)। প্রাসাদটি প্রায় ১,৪২,০০০ বর্গ মিটার (১৫,৩০,০০০ ফুট) এলাকাজুড়ে বিস্তৃত।
 
স্পেনে মুসলিম শাসনে কর্ডোভা হয়ে ওঠে ইউরোপের সবচেয়ে মনোরম জনপদ। প্রায় পাঁচ হাজার মিল-কারখানা ছিল শুধু কর্ডোভাতেই। তখন ইউরোপের ৯৯ শতাংশ লোক অশিক্ষিত ছিল। আর কর্ডোভাতেই ছিল ৮০০ পাবলিক স্কুল। তৎকালের ইউরোপে গোসলখানার ধারণাই ছিল না। অথচ তখন মুসলমানরা কর্ডোভাতে ৯০০ হাম্মামখানা বা গণ-গোসলখানা বানিয়েছিলেন। দশম শতকে কর্ডোভাতে ছিল ৭০০ মসজিদ, ৬০ হাজার প্রাসাদতুল্য বাড়ি। ছিল ৭০টি লাইব্রেরি, যার সবচেয়ে বড়টিতে ছিল ছয় লাখ পুস্তক। সে সময় বছরে ৬০ হাজার পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশিত হতো। অথচ ইতিহাসের অমোঘ বিধানে ১৪৯২ স্পেনের তৎকালীন শাসক আবু আবদুল্লাহ (স্থানীয় পরিচিতি ববদিল) ফার্ডনান্ড ও ইসাবেলার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। আমেরিকা বিজয়ী ক্রিস্টোফার কলম্বাস এ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেন।
 
পরাজয়ের ধারায় মুসলিম শাসক আবু আবদুল্লাহ যখন বিজয়ীদের হাতে আল হামরার চাবি তুলে দেন, তখন তিনি অঝোড়ে কাঁদছেন দেখে আবদুল্লাহর মা বলেছিলেন, ‘পুরুষের মতে যা রক্ষা করতে পারোনি, তার জন্য নারীর মতো কাঁদতে পারো না তুমি। ’
 
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর
 
 
captcha