ভারতে ১০ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী সরকার দেশটির ২০ কোটি মুসলমানকে বিপজ্জনক ও অবাঞ্ছিত হিসাবে অভিহিত করে আসছে। সম্প্রতি, ভারতের জাতীয় নির্বাচনে তিনি এবং তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) মুসলানদের বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণামূলক আচরণকে একটি নতুন স্তরে নিয়ে গেছেন, যেখানে টানা তৃতীয়বারের মতো পাঁচ বছরের মেয়াদে তারা জয়ী হবেন বলে ধরাণা করা হচ্ছে।
মোদি এবং তার অনুসারীরা ভারতের মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসাবে সরাসরি উল্লেখ করেছেন। এবং এবারের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর দেশটিকে একটি বিশুদ্ধ হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। এটি দু:খজনকভাবে ভারতীয় মুসলমানদের কাছে গত এক দশকের অবমাননা, সহিংসতা এবং হত্যাযজ্ঞের পর একটি ভয়ঙ্কর সময়ের সূচনার ইঙ্গিত। দিল্লি থেকে ভারতের সাংবাদিক ও লেখক মোহাম্মদ আলির ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার বিজেপির চরমপন্থী প্রচেষ্টা নিয়ে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম্স-এর কলামে বলেছেন যে, তিনি আগে সালামের সাথে ফোনে উত্তর দিতেন। কিন্তু এখন তিনি চান না মানুষ জানুক যে, তিনি একজন মুসলিম। তিনি এখন জনসমক্ষে টুপি এবং ঢিলেঢালা পাঠানি কুর্তা পরেন না এবং উর্দু পরিহার করেন, যেগুলো সবই ভারতীয় মুসলমানদের পরিচয় চিহ্নিতকারী। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতে মুসলমানদের এমন ঝুঁকি নেয়ার পরিণতি বিপজ্জনক।
মোহাম্মদ আলি লিখেছেন, ‘ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার আবাসস্থল। ইসলাম প্রায় ১৩শ’ বছর আগে এখানে এসেছিল এবং ভারতীয় মুসলমানরা এই ভূখ-ের আদিবাসীদের থেকে এসেছে যারা বহু শতাব্দী আগে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
অনেক ভারতীয় মুসলমান ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল এবং লাখ লাখ মুসলমান ১৯৪৭ সালের বিভাজন প্রত্যাখ্যান করেছিল, যেখানে বেশিরভাগ হিন্দু ভারতে এবং বেশিরভাগ মুসলিম পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিল। ভারত আমাদের জন্মভূমি, এবং আমার মতো লোকেরা গর্বিত দেশপ্রেমিক।
কিন্তু মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদ আমাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে, যা সম্ভবত এই বিশে^র মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় মৌলবাদীকরণ। এর বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রতিষ্ঠার সাথে, একটি ডানপন্থী হিন্দু সংগঠন, যেটি ভারতে একটি সম্পূর্ণ হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল এবং সেই যুগের ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।’
আলি লিখেছেন যে, যখন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের একটি রাজনৈতিক শাখা মোদির বিজেপি ২০১৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তিনি এবং তার অনুসারীরা এটিকে হিন্দু সভ্যতার মুহূর্ত হিসাবে দেখেছিলেন যার জন্য হিন্দুত্ববাদীরা অপেক্ষা করছিল। মোদি তাদের কাছে হলেন ঈশ্বর-রাজা যিনি হিন্দু সভ্যতাকে শতাব্দীর আধিপত্য থেকে মুক্ত করতে আবির্ভূত হয়েছেন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রভাব থেকে, যেটি প্রায় তিন শতাব্দী ধরে ভারত শাসন করেছিল এবং ব্রিটিশ উপনিবেশকারীদের দ্বারা সমাপ্ত হয়েছিল।
আলি আরও লিখেছেন, ‘ইসলাম বিদ্বেষ ভারতে নতুন নয়, এবং মুসলমানরাও প্রজন্মাতরের পক্ষপাত এবং পুনরাবৃত্ত সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছিল, যেখানে উদার উচ্চবর্ণের হিন্দু অভিজাতরা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। কিন্তু মোদির ডানপন্থী নেতৃত্বে মুসলিম বিদ্বেষ কার্যকরভাবে রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়েছে।
যখন ভারতীয় মুসলমানরা প্রতিবাদ করেছিল, তখন মোদির একজন সমর্থক একটি উত্তেজক বক্তৃতা দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, যাকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত দিল্লির হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে মারাত্মক সংঘর্ষের জন্য দায়ী করা হয়। সেই সময় পুলিশকে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকার অভিযোগ করা হয়েছিল যখন মুসলমানদের দোকানগুলি ধ্বংস করার, লাঞ্ছিত করার এবং এমনকি হত্যা করা হচ্ছিল।
কিছু রাজ্য মূলত মুসলিম-হিন্দু সম্পর্ককে অবৈধ করে তুলেছে একটি অযৌক্তিক হিন্দু ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ভিত্তিতে যে, ভারতকে একটি মুসলিম জাতিতে পরিণত করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মুসলিম পুরুষরা হিন্দু নারীদের প্ররোচিত করছে।
আমার মা আর খাসির গোশÍ দেন না যা আমি তাকে দেখতে যাওয়ার পর দিল্লিতে নিয়ে যেতাম। তিনি ভয় পান যে, এটিকে গরুর গোশÍ বলে ভুল করা হবে। হিন্দুদের কাছে পবিত্র গরু বা গরুর গোশÍ খাওয়া বা রাখার সন্দেহে কয়েক ডজন মুসলমানকে হিন্দু জনতা হত্যা বা লাঞ্ছিত করেছে বলে জানা গেছে।
নিজেকে অস্বীকার করা গভীর হতাশার দিকে পরিচালিত করে। এর ক্রমবর্ধমান ওজন মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক ও হতাশার মানসিক স্বাস্থ্য সঙ্কটও তৈরি করেছে। তবুও ভারতে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকের চরম ঘাটতি এবং আমাদের নতুন বাস্তবতা সম্পর্কে অনেক অমুসলিম চিকিৎসকের সীমিত বোধগম্যতার কারণে অনেক মুসলমান নিজের সাথে মানিয়ে নেয়া কঠিন হচ্ছে।
আমি এই রচনাটি লিখতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল. আমার প্রতিবাদ করার, কথা বলার কথা নয়। আমি যখন মাঝে মাঝে এটা নিয়ে অনলাইনে পোস্ট করি, তখন সাধারণ প্রতিক্রিয়া হয়, 'পাকিস্তানে চলে যাও।' কিন্তু আমি কেন চলে যাব? আমি একজন ভারতীয়। আমি এখানে জন্মগ্রহণ করেছি, আমার পূর্বপুরুষদের মতো যারা পাকিস্তানের সাথে বিভক্তির ধর্মীয় ভিত্তির বিরোধিতা করেছিলেন এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ভারতীয় আদর্শে বিশ্বাস করেছিলেন।