আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুসারে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির দক্ষিণে মালয়েশিয়া, পশ্চিমে মিয়ানমার, উত্তরে লাওস রাজতন্ত্র এবং পূর্বে লাওস, কম্বোডিয়া ও সিয়াম উপসাগর (প্রশান্ত মহাসাগরের অংশ) সীমান্তবর্তী। থাইল্যান্ড একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র, যেখানে রাজার আইনগত মর্যাদা থাকলেও ক্ষমতা কার্যত মন্ত্রিসভার হাতে ন্যস্ত। সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় ধর্ম বৌদ্ধধর্ম এবং রাজাকে অবশ্যই বৌদ্ধ হতে হয়। তবে ইসলাম এখানে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম, এরপর খ্রিষ্টান ও হিন্দুধর্মের অবস্থান।
থাইল্যান্ডে ইসলামের আগমন নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন আরব উপদ্বীপ থেকে আগত আরব বণিকদের হাত ধরে ইসলাম এখানে প্রবেশ করে। আরেকটি মতে, ভারতের মুসলিম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইসলাম বিস্তার লাভ করে। আবার অনেক ইতিহাসবিদের মতে, ১৫শ শতকে মালয়েশিয়ার মাধ্যমে ইসলাম থাইল্যান্ডে প্রবেশ করে। তবে অধিকাংশ গবেষক একমত যে, ১৩ বা ১৪ শতকে ইসলাম এখানে শেকড় গেড়ে বসে।
দক্ষিণের চার প্রদেশ—নারাতিউয়াত, ইয়ালা, পাতানি ও সাতুনে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এখানে মুসলিম জনসংখ্যা প্রদেশভেদে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত। এসব অঞ্চলের প্রত্যেকটিতে ইসলামিক কাউন্সিল রয়েছে, যারা মসজিদ নির্মাণ, বিবাহ-তালাক ও ধর্মীয় শিক্ষার তত্ত্বাবধান করে।
তবে ইসলামী শিক্ষার মানোন্নয়নে এখনও সংকট রয়েছে। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক ইসলামিক স্কুল উন্নতি করতে পারছে না। ফলে তহবিল সংগ্রহে স্থানীয় কাউন্সিলগুলো বিভিন্ন মুসলিম দেশ ও সরকারের সহায়তা চাইছে।
থাইল্যান্ডের মুসলমানরা পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করেন। তারা মসজিদে নামাজ আদায়, ঈদ ও অন্যান্য ইসলামী উৎসব পালন এবং এমনকি রাজধানীর উন্মুক্ত স্থানে মহানবী (সা.)-এর জন্মদিন উদযাপন করতে পারেন। মুসলিমদের ব্যক্তিগত আইন—যেমন বিবাহ, তালাক ও উত্তরাধিকার—রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। হজ পালনের জন্য মুসলিম সরকারি কর্মকর্তাদের বেতনসহ ছুটি দেওয়া হয়। প্রতিবছর গড়ে ২ হাজার থাই নাগরিক হজে অংশ নেন।
মুসলমানরা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলেছেন। বর্তমানে প্রায় ৩০টি মুসলিম সংগঠন রয়েছে, যদিও অধিকাংশ সক্রিয় নয়। দুটি মুসলিম রাজনৈতিক দলও বিদ্যমান। এছাড়া রাজধানী ব্যাংককে একটি আধুনিক ইসলামিক কলেজ এবং একটি কেন্দ্রীয় ইসলামিক সেন্টার সক্রিয় রয়েছে।
ব্যাংকক ইসলামিক সেন্টার মুসলমানদের জন্য দারিদ্র্য বিমোচন, বৃত্তি প্রদান, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। কেন্দ্রটির বার্ষিক বৃত্তি কর্মসূচি থেকে প্রায় ১,৫০০ থেকে ২,০০০ শিক্ষার্থী উপকৃত হয়।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৪,০০০ মসজিদ ও নামাজঘর রয়েছে, এর মধ্যে প্রায় ২০০টি ব্যাংককে। দক্ষিণাঞ্চলেই মসজিদের ঘনত্ব বেশি। সরকার প্রতি বছর মসজিদের সংস্কার ও নতুন মসজিদ নির্মাণে অর্থ সহায়তা প্রদান করে।
দক্ষিণের মুসলমানরা প্রধানত কৃষিকাজ, রাবার চাষ, ছোট ব্যবসা ও স্বর্ণখনিতে শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। রাজধানী ব্যাংককে প্রায় আড়াই লাখ মুসলমান বসবাস করেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষিত ও পেশাজীবী।
থাইল্যান্ডে মুসলিমদের ধর্মীয় প্রধানকে শেখুল ইসলাম বলা হয়। তিনি মুসলমানদের মনোনয়নক্রমে আজীবনের জন্য রাজার মাধ্যমে নিযুক্ত হন এবং সরকারের মুসলিম বিষয়ক পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সব মিলিয়ে, থাইল্যান্ডের মুসলমানরা ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করলেও শিক্ষা, সাংগঠনিক শক্তি ও আর্থিক সংহতির অভাবে অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন। তবুও বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে তারা এক প্রাণবন্ত ও গতিশীল সমাজ হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করেছেন। 4284803#