IQNA

মহানবীর (সা) চরিত্র সম্পর্কে বিশ্বের দার্শনিক ও চিন্তাবিদরা যা বলেছেন:

20:46 - September 07, 2025
সংবাদ: 3478023
ইকনা - ইসলামের মহানবী হলেন মানবতার ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব এবং ঐশী নবীদের মধ্যে শেষ, যিনি মানবতাকে একত্ববাদ ও ন্যায়বিচারের দিকে পরিচালিত করার লক্ষ্যে তাঁর বিশ্বব্যাপী মিশন শুরু করেছিলেন।

ইসলামের মহানবীর (সা) জীবন নৈতিক, মানবিক এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষায় পরিপূর্ণ যা ইসলাম ও মানবতার ইতিহাসে গভীর ও স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে এবং পশ্চিমা ও অমুসলিম প্রাচ্যবিদরা তাঁর ব্যক্তিত্বের ব্যাপক প্রশংসা করেছেন। নানা বই ও ভাষণে তারা এইসব প্রশংসা করে গেছেন। এখানে সেইসব প্রশংসার কিছু নির্বাচিত অংশ তুলে ধরছি: 

মাইকেল এইচ হার্ট 

"ইতিহাসের ১০০ জন সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ( The 100: A Ranking of the Most Influential Persons in History।)" হল আমেরিকান লেখক মাইকেল হার্টের লেখা একটি বই, যা ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইয়ে, ইতিহাসের এক নম্বরে তথা সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের তালিকায় প্রথম ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃত হন ইসলামের মহানবী-সা। এই বইয়ে তিনি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে ইসলামের নবীকে বেছে নেয়ার বিষয়ে বলেছেন: তিনিই ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি যিনি আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত উভয় দিক থেকেই অসাধারণভাবে সফল ছিলেন। মুহাম্মদ ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্ম প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করেছিলেন এবং একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠেন। মৃত্যুর তেরো শতাব্দী পরেও, তাঁর প্রভাব শক্তিশালী এবং বিস্তৃত যা তাঁকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি করে তুলেছে।

উইলিয়াম মন্টোগোমারি ওয়াট

স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক এবং পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে বিশিষ্ট অমুসলিম ভাষ্যকার হিসেবে বিবেচিত উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াট (১৯০৯-২০০৬) নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী নিয়ে দুটি বই লিখেছেন: একটি হলো "মক্কায় মুহাম্মদ" এবং অন্যটি হলো "মদিনাতে মুহাম্মদ", যা তিনি ১৯৫৩ সালে লিখেছিলেন।
নিজের বিশ্বাসের জন্য তাঁর নির্যাতন সহ্য করার প্রস্তুতি, যারা তাকে বিশ্বাস করেছিল ও যারা তাঁঁকে অনুসরণ করেছিল এবং তাঁকে তাদের নেতা ও দিশারী বলে মানতেন তাঁদের মহৎ নৈতিক স্বভাব ছাড়াও, মুহাম্মদের কৃতিত্বের মহত্ত্ব ও ঔজ্জ্বল্য-এসবই তাঁর সত্তার মধ্যে প্রোথিত স্বভাগত ন্যায়বিচার ও সততার নিদর্শন।"

তিনি বলেছেন, মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি আন্তরিকভাবে ও সৎ নিয়ত নিয়ে এবং সঠিক বিশ্বাস নিয়ে মহান আল্লাহর নানা বাণী প্রচার করতেন।

মহানবীর চিন্তাধারার উৎস যে ছিলেন মহান আল্লাহ বিভিন্ন ব্যক্তির সেই মতের দিকে ইঙ্গিত করে মন্টগোমারি বলেছেন, এটা বলা যেতে পারে যে এইসব চিন্তাধারা এমন সব ব্যক্তিদের জীবনের অর্জন যারা নিজ যুগের চেয়ে বড়।

তিনি আরও বলেছেন, মুহাম্মাদের ব্যক্তিত্ব ছিল এমনই যে তা মানুষের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস অর্জন করেছিল। ধর্মীয় সাধনার পাশাপাশি তাঁর চরিত্রে ছিল দৃঢ়তার সঙ্গে দয়ার মিশ্রণ, সাহসিকতা ও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতার মত নানা উপযুক্ত গুণ। মন্টগোমারি বলেছেন, মহানবীর স্বভাব ও আচার-আচরণ এমনই পছন্দনীয় ছিল যে সবাই তাঁর বন্ধু হয়ে পড়তেন ও তাঁকে ভালবাসতেন এবং সবাই তাঁর জন্য ত্যাগ- স্বীকারে প্রস্তুত থাকত স্বেচ্ছায়। সামাজিক অসন্তোষ এবং ইরানি ও রোমান সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের কারণে ইসলামের বিস্তার ঘটেছে এমন ধারণা ঠিক নয়, আসলে এ ধর্মের প্রসার মহানবীর নানা গুণ, বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা ছাড়া সম্ভব হত না।

বার্থোল্ড সেন্ট হিলায়ার

জার্মান প্রাচ্যবিদ বার্থোল্ড সেন্ট হিলায়ার (১৭৯৩-১৮৮৪) তাঁর "প্রাচ্যের মানুষেরা ও তাঁদের বিশ্বাস" বইতে লিখেছেন: মুহাম্মদ সকলকে এক ঈশ্বরের দিকে ডাকতেন। আর এই আহ্বানে তিনি তাঁর শত্রুদের সাথেও দয়া ও করুণার সাথে আচরণ করতেন।তাঁর ব্যক্তিত্বে দুটি মূল্যবান মানবিক গুণ স্পষ্ট ছিল: ন্যায়বিচার এবং করুণা।

এডুয়ার্ড মন্টে

"এডুয়ার্ড মন্টে", ফরাসি দার্শনিক এবং প্রাচ্যবিদ, (১৮১৭-১৮৯৪) তার "আল-আরব" বইতেও লিখেছেন: "মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর উদ্দেশ্যের পবিত্রতায়, দয়ায়, শাসনের ক্ষেত্রে ন্যায্যতায় এবং তাঁর চিন্তাভাবনা প্রকাশ ও বাস্তবায়নেও তাঁর পবিত্রতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। সংক্ষেপে, তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে ধার্মিক ও সবচেয়ে করুণাময় ব্যক্তিত্ব এবং শাসনভার অক্ষুণ্ণ রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব, তিনি মানুষকে এমন একটি জীবনের দিকে পরিচালিত করেছিলেন যা তারা কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি। তিনি তাদের জন্য একটি উন্নত সরকার ও ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা আজও টিকে আছে।"

জিন-জ্যাক রুশো

ফরাসি লেখক, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক এবং আঠারো শতকের জ্ঞানদান দর্শনের অন্যতম বিশিষ্ট প্রতিনিধি জিন-জ্যাক রুশো মহনবী (সা.) সম্পর্কে বলেছেন: "আজ পর্যন্ত, পৃথিবী এমন কোনও মানুষ দেখেনি যে মন ও হৃদয়কে মূর্তিপূজা থেকে এক ঈশ্বরের উপাসনার দিকে পরিচালিত করতে পারে, "মুহাম্মদ" ছাড়া।" এবং যদি তিনি সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে তাঁর জীবন শুরু না করতেন তাহলে এমনকি তাঁর নিকটতম লোকেরাও তাঁকে বিশ্বাস করতেন না, বিশেষ করে যখন তিনি এমন এক জাতির কাছে মহান আল্লাহর বার্তাবাহক হয়েছিলেন যাদের বিবেক ও হৃদয় কঠোর এবং পাষাণ হয়েছিল; কিন্তু মহান আল্লাহ যিনি তাঁকে তাঁর বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য মনোনীত করেছিলেন তাঁকে শৈশব থেকেই প্রস্তুত করেছিলেন।

আলফোনস ল্যামার্টিন

ফরাসি চিন্তাবিদ আলফোনস ল্যামার্টিন (১৭৯০-১৮৬৯) বলেছিলেন যে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা হল আমি ইসলামের মহানবীর জীবনী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অধ্যয়ন ও গবেষণা করেছি এবং তাঁর মাহাত্ম্য ও অমরত্ব উপলব্ধি করেছি। ত ব্যক্তিরা অস্ত্র তৈরি করেছিলেন, আইন তৈরি করেছিলেন এবং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; কিন্তু এই ব্যক্তি, মুহাম্মদ (সা.) সেনাপতিত্ব করতেন না, আইন তৈরি করেননি, সাম্রাজ্য পরিচালনা করেননি, অথবা মানুষের ওপর শাসন করেননি; কিন্তু তাঁর নেতৃত্ব লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথ দেখিয়েছিল যারা তখন বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ ছিল, এবং শুধু তাই নয়, এটি মিথ্যা ধারণা এবং বিশ্বাসগুলোকেও ধ্বংস করেছিল।

বার্নার্ড শ

"বার্নার্ড শ", একজন ইংরেজ লেখক (১৮৫৬-১৯৫০) বলেছেন: আমি ইসলামের রাসূলের জীবন বারবার মনোযোগ সহকারে পড়েছি এবং এতে সৃষ্টিশীলতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইনি, আর আমি কতটা আকাঙ্ক্ষা করি যে এই ধর্ম যেন সমগ্র বিশ্বের পথ ও পদ্ধতি হোক।

রাম কৃষ্ণ

"রাম কৃষ্ণ" হিন্দু ধর্মীয় নেতা (১৮৮৬) তার "প্রফেট মুহাম্মদ" বইতে লিখেছেন: মুহাম্মদের ব্যক্তিত্বের সকল দিক জানা সম্ভব নয়, তবে আমি যা দিতে পারি তা হল তাঁর জীবনের দিকে এক ঝলক দৃষ্টি দেয়া বা সামগ্রিক দৃষ্টিপাত যাতে রয়েছে একের পর এক কেবলই সুন্দর ছবি।  "তিনি হলেন নবী মুহাম্মদ, যোদ্ধা মুহাম্মদ, বণিক মুহাম্মদ, মুহাম্মদ রাজনীতিবিদ, মুহাম্মদ বক্তা, মুহাম্মদ সংস্কারক, মুহাম্মদ এতিমদের আশ্রয়স্থল, মুহাম্মদ দাসদের রক্ষক, মুহাম্মদ দাসদের মুক্তকারী এবং মুহাম্মদ ন্যায়বিচারকারী। এই সমস্ত আশ্চর্যজনক ভূমিকা তাঁকে একজন বীরে পরিণত করেছে।"

লিও টলস্টয়

বিখ্যাত রুশ লেখক (১৮২৮-১৯১০) লিও টলস্টয় বলেছেন: "মুহাম্মদের জন্য এ গৌরবই যথেষ্ট যে তিনি একটি পথহারা অধম জাতিকে অজ্ঞতার ঐতিহ্য ও রীতিনীতির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলেন এবং তিনি তাদের জন্য অগ্রগতির দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন, এবং মুহাম্মদের শরীয়ত যুক্তি ও প্রজ্ঞার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার কারণে সমগ্র বিশ্বে রাজত্ব করবে।

উইলিয়াম মুইর

উইলিয়াম মুইর (১৮১৯-১৯০৫) তার "দ্য হিস্ট্রি অফ মুহাম্মদ" বইতে লিখেছেন: "মুসলিমদের নবী মুহাম্মদকে শৈশব থেকেই আমিন বলা হত তার মহৎ চরিত্র এবং সদাচারণের কারণে, এবং এর পাশাপাশি তার চরিত্র এতই উন্নত যে কোনও বর্ণনাকারী তার মহৎ গুণাবলী পুরোপুরি বর্ণনা করতে পারে না। তারা অজ্ঞতা ওজ্ঞানের অভাবের কারণে কখনই তাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারবে না। অবশ্য যে কেউ তাঁর জীবনের গৌরবময় ইতিহাস নিয়ে চিন্তাভাবনা এবং গবেষণা করবে, যা তাকে বিশ্বের নবী ও চিন্তাবিদদের সামনের সারিতে স্থান দিয়েছে, সে তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সীমিত মাত্রায় বা কিছুটা হলেও সচেতন হবে।"

বার্ট্রান্ড রাসেল

"বার্ট্রান্ড রাসেল," একজন মহান ব্রিটিশ দার্শনিক এবং ১৯৫০ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কার পান। তিনি বলেছেন: "আমি ইসলাম ও ইসলামের নবী সম্পর্কে পড়াশুনা করেছি এবং আমি বুঝতে পেরেছি যে এটি এমন একটি ধর্ম যা বিশ্ব ও মানবতার ধর্ম হওয়ার যোগ্য, এবং আমরা এখনও মুহাম্মদের আনা শিক্ষাগুলো ব্যাখ্যা করি এবং পরীক্ষা করি, আর এ জন্য আমরা সর্বোচ্চ পুরষ্কার পাচ্ছি।"

গুস্তাভ লে বন

ফরাসি প্রাচ্যবিদ (১৮২১-১৯২১) গুস্তাভ লে বন বলেছেন: যদি মানুষের মূল্য তাদের কর্মের মহত্ত্ব দিয়ে পরিমাপ করা হয়, তাহলে মুহাম্মদ ছিলেন ইতিহাসের পরিচিত সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের মধ্যে একজন, এবং কিছু পশ্চিমা পণ্ডিত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি ন্যায়বিচার এবং ন্যায্যতা পর্যবেক্ষণ করেন, যদিও ধর্মীয় গোঁড়ামি অনেক ঐতিহাসিকের দৃষ্টিকে অন্ধ করে দিয়েছে যারা তাদের করুণার জন্য পরিচিত। #
 

পার্স টুডে

captcha