IQNA

অযত্ন-অবহেলায় বিলুপ্তির পথে লাল বিবির সমাধি

রংপুরে মোগল সম্রাজ্ঞী শহীদ লাল বিবির সমাধি

0:01 - August 15, 2022
সংবাদ: 3472292
তেহরান (ইকনা): রংপুর শহরের অদূরে মাহিগঞ্জে শুয়ে আছেন মোগল সম্রাজ্ঞী এবং ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ লাল বিবি। যিনি ছিলেন শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহের মা এবং সম্রাট দ্বিতীয় আকবরের স্ত্রী। ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহে নেতৃত্ব দান ও পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগে লাল বিবিকে শহীদ করা হয়।

লাল বিবির পরিচয় : লাল বিবি শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহের (১৮৩৭-১৮৫৭ খ্রি.) মা এবং সম্রাট দ্বিতীয় আকবরের (১৮০৬-১৮৩৭ খ্রি.) স্ত্রী ছিলেন।

 

সম্রাজ্ঞী লাল বিবির পিতৃনিবাস ছিল রংপুরের ফুলচৌকি গ্রামে। লাল বিবির পিতা ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী ফকির বিদ্রোহের সমরনায়ক শাহজাদা নুরুদ্দিন মুহাম্মদ বাকের জং, যাঁর অপর নাম ফকির মজনু শাহ। আর নুরুদ্দিন মুহাম্মদ বাকের ছিলেন মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের (১৭৬০-১৮০৬ খ্রি.) আপন চাচাতো ভাই ও ভগ্নিপতি।

রংপুরের সঙ্গে সম্পর্ক : ঐতিহাসিকদের দাবি, নুরুদ্দিন মুহাম্মদ বাকেরের পূর্বপুরুষরা ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে রংপুর অঞ্চলে আগমন করেন। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি বা প্রশাসক হিসেবেই রংপুরে তাঁদের আগমন হয়। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর ময়দানে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটলে তত্কালীন মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর (১৭৫৪-১৭৫৯ খ্রি.) জামাতা শাহজাদা নুরুদ্দিন মুহাম্মদ বাকের জং-কে বাংলার সুবেদার নিয়োগ দেন। সুবেদার নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি অত্র অঞ্চলের রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে রংপুরের ফুলচৌকিতে স্থানান্তর করেন।

 

শহীদ পরিবার : সম্রাজ্ঞী লাল বিবির পুরো পরিবার ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামে শহীদ হন। তাঁর বাবা শহীদ নরুদ্দিন বাকের মুহাম্মদ জং ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৭৮৩ বর্তমান লালমনিরহাট জেলার মোগলহাটে ইংরেজ আক্রমণের শিকার হন। পরের দিন নিজ গ্রাম ফুলচৌকিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। লাল বিবির বড় ভাই শাহজাদা কামাল মুহাম্মদকে ইংরেজরা গুপ্ত ঘাতকের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগ করে শহীদ করে এবং ছোট ভাই শাহজাদা জামাল মুহাম্মদ সম্মুখসমরে শহীদ হন। কামাল মুহাম্মদের ছেলে শাহজাদা নাসিরুদ্দিন মুহাম্মদকে সিপাহি বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ব্রিটিশরা বিষ প্রয়োগ করে শহীদ করেন। কথিত আছে, তিনি সিপাহি বিদ্রোহের সময় বাহাদুর শাহ জাফরের প্রধান সেনাপতি ছিলেন। লাল বিবির বোন চাঁদ বিবির স্বামী শহীদ ওয়ালিদাদ মুহাম্মদ ছিলেন সিপাহি বিদ্রোহের সহ-অধিনায়ক। তাঁকেও ব্রিটিশরা নির্মমভাবে শহীদ করে। চাঁদ বিবি নিজেও সম্মুখসমরে শহীদ হন বলে জনশ্রুতি আছে।

 

শহীদ নুরুদ্দিন মুহাম্মদ বাকের, শহীদ কামাল মুহাম্মদ, শহীদ জামাল মুহাম্মদ, শহীদ নাসির মুহাম্মদ ও তাঁর স্ত্রী শহীদ আমিরুন নেসার কবর রয়েছে মিঠাপুকুরের ফুলচৌকি মসজিদ প্রাঙ্গণে। আর শহীদ ওয়ালিদাদ মুহাম্মদ শুয়ে আছেন রংপুর শহরের মুন্সিপাড়া কবরস্থানে। চাঁদ বিবির কবর সমর দীঘির পারে ছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে বর্তমানে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

 

লাল বিবির শাহাদাত : ১৮৭৩ সালে ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধের সময় বৃদ্ধা লাল বিবি পিত্রালয় ‘নগরে’ আসেন এবং সৈন্য সংগ্রহের জন্য সেনানায়ক মহারাজ ভবানী পাঠকসহ মীরগঞ্জের দিকে যাত্রা করেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তখন ব্রিটিশ সেনানায়ক অকল্যান্ডের অতর্কিত আক্রমণে লাল বিবি ও ভবানী পাঠক নিহত হন। সেখানেই একটি দীঘির পারে তাঁকে সমাহিত করা হয়। দীঘিটি এখনো সমর দীঘি বা জিহাদ পুকুর নামে পরিচিত। তাঁদের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে কয়েকজন ফকির বিদ্রোহী শহীদ হন। শাহাদাতের পূর্বে লাল বিবি ঘোড়ার পিঠ থেকে যখন লুটিয়ে পড়েন, তখন তিনি ফরিয়াদ করেন, ‘হে আল্লাহ! আমার এই মৃত্যুকে তুমি কবুল কোরো। আমার এই শাহাদাত যেন ব্যর্থ না হয়। ’

 

সম্রাজ্ঞী লাল বিবি ও মহারাজ ভবানী পাঠককে হত্যার কাজে সহযোগিতা করার পুরস্কার হিসেবে পায়রাবন্দের টাটি শেখ ও খয়ের উদ্দীন প্রামাণিক ও জনৈক লাহিড়ীকে ৬০ লাখ টাকার অধিক মূল্যমানের জমিদারি দান করা হয়। তাদের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে স্থানীয় লোকসাহিত্যে একটি ছড়া পাওয়া যায়। তা হলো—

 

 

 

টাটি পাইল মাটি

 

খয়ের উদ্দীন পাইল লাট

 

লাহিড়ী পাইল ঠাকুরবাড়ি

 

তার তামাশা দেখ।

 

আল্লাহ সব শহীদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিন। আমিন।

 

তথ্যঋণ : ‘পলাশী যুদ্ধোত্তর আযাদী সংগ্রামের পাদপীঠ’ গ্রন্থ ও লাল বিবির সমাধিস্থলে স্থাপিত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক স্থাপিত তথ্য বিবরণী

 

 

captcha