
ইকনা প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গারা দক্ষিণ এশিয়ার একটি জাতিগোষ্ঠী, যারা প্রধানত মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন (সাবেক আরাকান) প্রদেশে বাস করে। ২০১৭ সালের সামরিক গণহত্যার আগে প্রায় ১৪ লক্ষ রোহিঙ্গা সেখানে ছিল, যাদের মধ্যে ৭ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ সেই বছর বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
রোহিঙ্গাদের ওপর দীর্ঘদিনের নিপীড়ন
১৯৬২ সাল থেকে মিয়ানমারের সামরিক সরকার ধারাবাহিকভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে আসছে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের “জাতীয় জনগোষ্ঠী” তালিকা থেকে বাদ দিয়ে কার্যত রাষ্ট্রহীন করা হয়। ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সামরিক অভিযানগুলো জাতিসংঘের মতে “গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ” হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
ভাষা ও সংস্কৃতি মুছে ফেলার চক্রান্ত
রোহিঙ্গা ভাষা চট্টগ্রামের উপভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত, তবে মিয়ানমারে এই ভাষার ব্যবহার লিখিতভাবে নিষিদ্ধ। অতীতে ইংরেজি, উর্দু বা বার্মিজ ভাষায় প্রশাসনিক যোগাযোগ হতো। ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো আরবি-ফার্সি বর্ণমালার ভিত্তিতে লেখার চেষ্টা হয়। ১৯৮৫ সালে ইসলামী শিক্ষক মুহাম্মদ হানিফ “হানিফি লিপি” উদ্ভাবন করেন, যা ২০১৮ সালে ইউনিকোডে যুক্ত হয় — এটি রোহিঙ্গা সংস্কৃতি সংরক্ষণের এক ঐতিহাসিক অগ্রগতি হিসেবে দেখা হয়।
রোহিঙ্গা কুরআন অনুবাদ প্রকল্প
এই প্রকল্পের উদ্যোগ নেন মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ধর্ম বিষয়ে পিএইচডি অধ্যয়নরত রোহিঙ্গা গবেষক কুতুব শাহ। তিনি কুয়ালালামপুরভিত্তিক দাওয়াহ কর্নার বুকস্টোর-এর সহযোগিতায় প্রকল্পটি চালু করেন।
কারণ রোহিঙ্গাদের বড় অংশ পড়তে-লিখতে পারেন না, তাই প্রকল্পটি প্রথমে মৌখিক অনুবাদ (অডিও ও ভিডিও) হিসেবে শুরু হয়, তারপর লিখিত সংস্করণ প্রণয়ন করা হচ্ছে।
২০২১ সালে শুরু হওয়া মৌখিক অনুবাদের কাজ শেষ হয় ২০২৩ সালের আগস্টে। এতে কুরআনের আরবি তেলাওয়াতের সঙ্গে রোহিঙ্গা ভাষায় অনুবাদ যুক্ত করা হয়েছে। তেলাওয়াত করেন মক্কাজন্মী রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত ক্বারি মুহাম্মদ আইয়ুব, আর অনুবাদ পাঠ করেন কুতুব শাহ নিজে। এই অডিও–ভিডিও ফাইলগুলো “Rohingya Quran App”-এ (iOS ও Android) এবং rohingyaquran.com ওয়েবসাইটে পাওয়া যাচ্ছে।
লিখিত সংস্করণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বর্তমানে হানিফি লিপিতে কুরআনের লিখিত অনুবাদ তৈরি হচ্ছে — প্রথম পাঁচটি সূরা সম্পন্ন হয়েছে। দাওয়াহ কর্নার প্রকাশনা সংস্থা এই প্রকল্পের পরবর্তী ধাপে ২০০০ কপি ছাপিয়ে মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ ও সৌদি আরবে বিতরণের পরিকল্পনা করেছে।
তাদের মতে, এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় উদ্যোগ নয়, বরং একটি ভাষা ও জাতিগত পরিচয় পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম। প্রযুক্তির সহায়তায় রোহিঙ্গা ভাষার মান উন্নয়ন, লিপির মান নির্ধারণ এবং সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণে এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গা ভাষায় কুরআন অনুবাদ কেবল একটি ধর্মীয় কাজ নয়; এটি নিপীড়িত এক জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার প্রতীকী প্রচেষ্টা — যা ভাষাগত বৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিশ্বব্যাপী কুরআন অনুবাদের চলমান ধারায় এক নতুন অধ্যায় যোগ করেছে। 4299046#