
ইতিহাস সাক্ষী দেয়, ব্যাপক খুনাখুনি ও রক্তপাত ছাড়া কোনো ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়নি। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ওপর চাপিয়ে দেয়া ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ সরকারের তৈরি করা ইহুদিবাদ নামক প্রকল্পের আওতায়। কাজেই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে ইহুদিবাদীদের বিতাড়িত করার জন্যও ব্যাপক রক্তপাতের প্রয়োজন হচ্ছে। আজ গাজা উপত্যকায় যে রক্তপাত চলছে তা ইহুদিবাদ নামক প্রকল্পকে উৎখাতের অনিবার্য মূল্য হিসেবে ধরে নেয়া যায়। পার্সটুডের এই নিবন্ধে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব:
ইহুদিবাদ নামক প্রকল্পের জন্মলগ্ন থেকে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে যে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান শুরু হয় সে সম্পর্কে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো এখন পর্যন্ত নীরবতা অবলম্বন করে এসেছে। এই প্রক্রিয়াটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ইহুদিবাদ মূলত একটি ঔপনিবেশিক শাসন, কারণ এই প্রকল্পের শাসকেরা অন্যান্য উপনিবেশবাদী শাসকদের মতো স্থানীয় জনগণকে নির্মূল করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে এসেছে।
জ্ঞাতসারে সহিংসতা
আধুনিক ফিলিস্তিনে সহিংসতার ইতিহাস ১৮৮২ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৮৮২ সালে ইহুদিবাদী অভিবাসীদের প্রথম দলটি ফিলিস্তিনে পৌঁছায়। ওই একবারই তারা সহিংস আচরণ ছাড়াই ফিলিস্তিন অনুপ্রবেশ করে। এরপর ইহুদিবাদীরা সহিংস আচরণের মাধ্যমে ফিলিস্তিনে আসতে থাকে এবং তাদের এই সহিংসতা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিনে আসার আগেই স্থানীয় জনগণের বিরুদ্ধে জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের মহড়া দিয়ে এসেছিল। তাদের প্রকল্পের নাম ছিল ‘মনুষ্যবিহীন ভূখণ্ড’। অবশ্য ইহুদিবাদীরা ১৮৮২ সাল থেকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে আসতে শুরু করলেও তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে হাত দেয়ার জন্য ১৯১৮ সালে ব্রিটেনের হাতে ফিলিস্তিন দখল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। এর দুই বছর পর ১৯২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিনের ১১টি গ্রামের অধিবাসীদের কচুকাটা করে সেগুলোর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। মনে রাখতে হবে তখনও ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র গঠিত হয়নি। কিন্তু এ ধরনের সহিংসতার মাধ্যমে সে রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্র তৈরি হতে থাকে আর এ ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে রাখে পশ্চিমা দেশগুলো।
শুধুমাত্র ইহুদিদের জন্য
বিশ্বের ইতিহাসে সেটি ছিল একটি (ফিলিস্তিনি) জনগোষ্ঠীর মালিকানায় থাকা ভূখণ্ডকে প্রকৃত মালিকদের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নেয়ার প্রথম পদ্ধতিগত সহিংস প্রকল্প। ভূখণ্ডের মালিকানা গ্রহণের পাশাপাশি ফিলিস্তিনি জনগণের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও একের পর এক কেড়ে নিতে থাকে ইহুদিবাদীরা। ইহুদিবাদীদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে সহায়-সম্বল হারিয়ে ফিলিস্তিনি জনগণ আশপাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে থাকে। কিন্তু ওইসব দেশের পক্ষে বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য স্বাভাবিক ও স্বচ্ছল জীবন উপহার দেয়া সম্ভব ছিল না।
কুখ্যাত মন্দির ও ইন্তিফাদার সূচনা
ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে ইহুদিবাদীদের এই সহিংস আচরণ বিনা বাধায় চলতে থাকে। কিন্তু ১৯২৯ সালে প্রথমবারের মতো ফিলিস্তিনিরা সহিংস উপায়ে ইহুদিবাদীদের জবাব দেয়। ওই বছর আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্সে একটি ইহুদি মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয় ইহুদিবাদীরা। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এবারে মুখ বুজে সহ্য করেনি বরং তারা সহিংস উপায়ে ওই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে। ফিলিস্তিনিদের এই প্রত্যুত্তর পূর্ব পরকল্পিত বা সমন্বিত ছিল না। এর সাত বছর পর ব্রিটিশ সরকার যখন ব্যাপক মাত্রায় ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদীদের আনার সুযোগ করে দিল তখন ফিলিস্তিনিরা সংগঠিত উপায়ে এই প্রক্রিয়া প্রতিহত করার চেষ্টা শুরু করে। ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত চলা ওই প্রতিরোধ আন্দোলনকে প্রথম ইন্তিফাদা নামে অভিহিত করা হয়। আর সে প্রতিরোধ সংগ্রাম ‘আরব অভ্যুত্থান’ নামে পরিচিতি পায়। এতদিনে এসে ফিলিস্তিনি চিন্তাবিদরা ইহুদিবাদকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখতে পায়।
আত্মরক্ষার নামে হামলা
ইহুদিবাদীদের যে পেটোয়া বাহিনী ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে চরম সহিংস আচরণ করেছিল তার নাম ছিল হাগানা। হিব্রু ভাষার হাগানা শব্দের অর্থ আত্মরক্ষা। পরবর্তীতে ফিলিস্তিনের ওপর ইহুদিবাদীদের যেকোনো আগ্রাসী ও দমন অভিযানকে ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ নামে চালিয়ে দেয়া হয়। আর এ কারণে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর নাম দেয়া হয় ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্স বা ইসরাইলি আত্মরক্ষাকারী বাহিনী।
নিহতদের স্থানে সন্ত্রাসীদের বসিয়ে দেয়া
সকল উপনিবেশবাদী শাসনকে স্থানীয় জনগণের ওপর হামলাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু একমাত্র ইহুদিবাদীরা স্থানীয় ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসনকে আত্মরক্ষা বলে চালিয়ে দেয়। তারা নিজেদের আগ্রাসী তৎপরতাকে ‘আত্মরক্ষা’ এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মরক্ষামূলক হামলাকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, উপনিবেশবাদী শাসকেরা উপনিবেশবাদের শিকার দেশগুলোর জনগণের পক্ষ থেকে বাধ্য করা না হলে কিংবা আন্তর্জাতিক চাপের শিকার না হলে ঔপনিবেশিক শাসন ত্যাগ করে নিজ দেশে ফিরে গেছে। নব্য উপনিবেশবাদী শক্তি ইহুদিবাদীদেরকে তাই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করতে হলে তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের কোনো বিকল্প নেই বর্তমানে যে সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা। #
পার্সটুডে