
বার্তা সংস্থা ইকনা: ঐতিহাসিকভাবে আমরা দেখতে পাই, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টগণ সরকার পরিচালনার এই বাস্তবতার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত তাল মিলিয়ে চলেন। আমেরিকার রাজনীতিতে এটাই বাস্তবতা। অনেক সময় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশগ্রহণকারী ও দলের সমর্থকরা প্রেসিডেন্টের প্রতি জ্বালাতন শুরু করেন। তাদের বিশ্বাস, প্রেসিডেন্ট এজেন্ডা সমন্বয় করতে গিয়ে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও মূলনীতি উপেক্ষা ও পরিত্যাগ করছেন। কিন্তু ঝানু প্রেসিডেন্টগণ বুঝতে পারেনÑ একমাত্র সমঝোতা, মীমাংসা ও নমনীয়তার মাধ্যমেই তিনি এই দায়িত্ব পালনে সফল হতে পারেন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সেপারেশন অব পাওয়ার বা ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতি থেকে শিক্ষা লাভ করেন।
প্রশ্ন হলো, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মোড় পরিবর্তন করবেন কিনা। অনেক সময় এমনও দেখা গেছে, বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য মেয়াদের শুরুতেই উচ্চাভিলাষী ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী নতুন প্রেসিডেন্টদের প্রতি নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা যুক্তরাষ্টের ক্ষেত্রে নির্বাচনে জয়লাভের মধ্যেই শুধু জনগণের ম্যান্ডেট নিহিত নেই, পরাজিত পক্ষ তখনো কিছু ক্ষমতার উেসর অধিকারী থাকেন।
প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি একটি নতুন যুগের সূচনার অঙ্গীকার নিয়ে হোয়াইট হাউসে আসেন। কিন্তু তার মেয়াদকালে অধিকাংশ দেশীয় এজেন্ডার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কেননা কংগ্রেসে তখনও রক্ষণশীল ও দক্ষিণপন্থি ডেমোক্রাটদের প্রভাব ছিল। ১৯৬২ সালে কেনেডি এই কথা স্বীকারও করেছেন অকপটেÑ ‘আমি মনে করি বাস্তবতা হলো এখানে কংগ্রেস অনেক শক্তিশালী।’
১৯৮০ সালের নির্বাচনে নানা নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার পরও প্রেসিডেন্টের মেয়াদকালে হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভসে ডেমোক্র্যাটদের প্রাধান্যের কারণে তর্ক-বিতর্ক করেই সময় পার করতে হয়েছে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানকে। তিনি যতবারই দেশীয় নীতি নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন, ততবারই প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছেন। তাকে তার অভিলাষ কাটছাঁট করতে বাধ্য করা হয়। ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনেরও হয় একই দশা। এ সময় কংগ্রেসে প্রভাবশালী ছিলেন রিপাবলিকানরা।
অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০০৮ সালে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা কর্মসূচি মৌলিকভাবেই পুনর্বিন্যাস তথা পরিবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন। তিনি শুধু গুয়ানতানামো বে কারাগার বন্ধ করলেন। কিন্তু নাইন-ইলেভেনউত্তর সন্ত্রাসবাদবিরোধী কর্মসূচিকে রাখলেন যথাস্থানেই। বরং ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করলেন ড্রোন হামলা। আর এভাবেই শেষ করলেন তার শাসনামলের দুই মেয়াদকাল।
পরিবেশ-পরিস্থিতিও অনেক সময় নাটকীয়ভাবে যেকোনো কিছুর পরিবর্তনের কারণ হতে পারে এবং প্রেসিডেন্টকে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট নির্বাচনী প্রচারণার সময় অঙ্গীকার করেছিলেন যে, তিনি রাজকোষ ব্যবহারে রক্ষণশীল হবেন এবং অঙ্গরাজ্যের বাজেট কাটছাঁট করবেন। কিন্তু বিশ্ব মহামন্দার ভয়াবহতা ও ভোক্তাদের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে তিনি সেই অঙ্গীকার শেষপর্যন্ত রক্ষা করতে পারেন নি।
১৯৬৮ সালে রিচার্ড নিক্সন ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করবেন বলে ওয়াদা করলেন। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তার সীমাবদ্ধতা ধরা পড়ল। যদিও তিনি দক্ষিণ ভিয়েতনামবাসীদের লড়াইয়ে রেখে সেখান থেকে আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করতে পারতেন, তবু তিনি তা না করে উত্তর ভিয়েতনামবাসীদের ওপর বোমা হামলা অব্যাহত রাখলেন। তার এই কপট নীতির কারণে জাতীয়ভাবে হইচই পড়ে গিয়েছিল।
জর্জ ডব্লিউ বুশ বিল ক্লিনটনের জাতি গঠনের স্বাভাবিক প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালালেন। তিনি অঙ্গীকার করলেন বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা সীমিত করে আনবেন। কিন্তু এরপরই নাইন-ইলেভেনের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটল। বুশ কালবিলম্ব না করে জাতীয় নিরাপত্তার সাজ-সরঞ্জাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করলেন। আফগানিস্তান ও ইরাকের মতো দুটি বড় সামরিক অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে নিয়োজিত করলেন।
জিমি কার্টার আমেরিকার রাজনীতি যেভাবে কাজ করছে তাতে রূপান্তরের অঙ্গীকার করলেন। কিন্তু দিনশেষে তাকেও কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে আপস করতে হলো। কেননা তাদের ছাড়া কোনো আইন প্রণয়ন সম্ভব নয়। ১৯৮৮ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ শপথ নিলেন যে, তিনি কখনোই ট্যাক্স বাড়াবেন না। কিন্তু যখন এই কাজের সময় এলো, তখন তিনি শুধু জরুরিভাবে ওভাল অফিসের ঘাটতি কমালেন এবং রাজস্ব বাড়াতে ডেমোক্র্যাটদের নিয়ে কাজ শুরু করলেন।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও যে কোনো কোনো ইস্যুতে পিছুটান দেবেন তার কিছু আলামত ইতোমধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে। এরই মধ্যে তাইওয়ান নীতিতে তিনি পিছু হটেছেন। চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনালাপে মেনে নিয়েছেন একচীন নীতি। ইসরাইলি বসতি নির্মাণের ব্যাপারে দিয়েছেন মিশ্র সতর্কতা সংকেত। আবার ইরানের পরমাণূ কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করাও যে তার পক্ষে সম্ভব হবে না এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। সামগ্রিকভাবে তিনি নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার নীতি এখনও দৃঢ়ভাবে আঁঁকড়ে ধরে আছেন। বারবার বলছেন, তিনি তার মূল অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুত হবেন না। আসলে এটাই চাচ্ছেন তার সমর্থকরা। নির্বাচনের আগে তিনি শরণার্থীর ঢল থামাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। ক্ষমতাসীন হয়ে প্রথম থেকে তিনি তাই করার চেষ্টা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী প্রবেশে তার নিষেধাজ্ঞায় শেষ পর্যন্ত আদালত বাগড়া দিয়েছে। এভাবে ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স নীতির কাছে নতি শিকার করতে হচ্ছে। কিন্তু তিনি তার পূর্ববতী বক্তব্য থেকে সরে আসেননি। অর্থাৎ শরণার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য আজ হুমকিস্বরূপ। যদিও বাস্তবতা আসলে তা নয়। ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি মেক্সিকো সীমান্তে দেওয়াল তুলবেন। তিনি এজন্য অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। যখন রিপাবলিকানরা সতর্ক করতে শুরু করলেন যে, জনগণ ওবামার অ্যাফোরডেবল কেয়ার অ্যাক্ট-এর ওপর নির্ভরশীল, তখনও তিনি বলতে থাকেন, যদি দীর্ঘদিন ধরে তা চলতে থাকে তবে তিনি আইনটিও বাতিল করে দেবেন।
প্রকৃতপক্ষে বড় ধরনের পরিবর্তন সাধনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো আগ্রহ নেই। পলিটিকোর একটি নিবন্ধে উপসংহার টানা হয়েছে এভাবেÑ ‘প্রেসিডেন্ট পদে অভিষেক হওয়ার পর গত তিন সপ্তাহে যারা ট্রাম্পের সঙ্গে অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন, এমন প্রায় দু ডজন লোক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তারা বলেছেন, শাসনকার্যের বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ায় ট্রাম্পের মেজাজ বিস্ময় ও ক্ষোভে ভরা।’
ইতোমধ্যেই ট্রাম্প আদালতের মাধ্যমে প্রথম চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স বা ভারসাম্য নীতির মুখোমুখি হয়েছেন। গণবিক্ষোভও তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠেছে। তার বিরুদ্ধে যে গণআন্দোলন গড়ে উঠছে সেটাও উপেক্ষা করার কোনো পথ নেই। তাকে ধীরে চলো নীতিতে বাধ্য করছে কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট সদস্যরাও। কিছু রিপাবলিকান সদস্যও তার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন। লিনডন জনসন সর্বদা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলতেন। তিনি ১৯৬৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার করেন। কিন্তু পরে সিনিয়র রিচার্ড রাসেল ও ভাইস প্রেসিডেন্ট তাকে সতর্ক করে দেন যে, ১৯৬৫ সালের ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল একটি ভুল পদক্ষেপ। ফলে তিনি এই অঙ্গীকার থেকে সরে আসেন।
যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছু মূল ইস্যুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অস্বীকার করেন, তাহলে তিনি তার ক্ষমতার কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারবেন না। বিশেষ করে জাতীয় জরিপগুলি বলছে, এইসব ইস্যুতে তার অবস্থান দুর্বল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, নিক্সনের মতো প্রভাবশালী প্রেসিডেন্টকেও একসময় থামতে হয়েছে। অতএব, ট্রাম্পের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হবার কোনো কারণ নেই। ( মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব)
হ লেখক : প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক, নিউ আমেরিকার ফেলো এবং ‘জিমি কার্টার’ গ্রন্থের রচয়িতা, ইত্তেফাক