ইতিহাসে দেখা যায়, ইরানের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি পথ অতিক্রম করা ভ্রমণকারীরা তাদের নীচে বিস্তৃত শিরাজের দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন এবং প্রায়ই এর নির্মল সৌন্দর্যের প্রশংসায় 'আল্লাহু আকবার' বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেন।
শিরাজ কেবল ইরানের প্রাচীনতম নগরীগুলোর একটি নয়, এটি দেশটির সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবেও খ্যাত। ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ এই শহর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাহিত্য, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
শিরাজের পরিচয়ের কেন্দ্রে রয়েছে এর কবিতাময় ঐতিহ্য। হাফেজ, সা'দি, খাজু কেরমানি, জাহান মালেক খাতুন ও ওবায়দ-এ জাকানি প্রমুখ কিংবদন্তি কবি এই শহরের সাহিত্যিক উত্তরাধিকারের স্তম্ভ।
হাফেজ : শিরাজের বুলবুল
১৩২৫ সালে জন্মগ্রহণকারী খাজা শামসউদ্দিন মুহাম্মদ হাফেজ শিরাজি ইরানের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাঁর গীতিকবিতা বিশ্বজুড়ে পাঠক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করে আসছে।
শৈশবেই তিনি পবিত্র কুরআন মুখস্থ করেন, যার ফলে 'হাফেজ' উপাধি পান। আজীবন শিরাজেই অবস্থান করে তিনি লিখেছিলেন সেই গজলসমূহ, যা পারস্য সাহিত্যের চূড়ান্ত শৈল্পিক প্রকাশ বলে বিবেচিত।
তাঁর কবিতা আধ্যাত্মিক ধ্যান, কাব্যিক সৌন্দর্য ও দার্শনিক গভীরতায় পূর্ণ। হাফেজের গজল পারস্য সাহিত্যকে রূপ দিয়েছে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের চিন্তক ও লেখককে অনুপ্রাণিত করেছে, এবং আজও ইরানিদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে আছে।
মানুষ জীবনের নানা সংকটে দিকনির্দেশনা, অনুপ্রেরণা বা আত্মসমালোচনার জন্য তাঁর কবিতার শরণ নেয়।
হাফেজের প্রভাব ইরানের সীমা ছাড়িয়ে পশ্চিমা চিন্তাজগতে পৌঁছেছে। গ্যেটে, নীটশে, এমারসন প্রমুখ মনীষীরা তাঁর কবিতাকে আদর্শ কাব্যের নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং বছরের পর বছর তাঁর 'দেওয়ান' অধ্যয়ন করেছেন।
শিরাজের উত্তরে অবস্থিত হাফেজের সমাধি- 'হাফেজিয়েহ' আজও একটি জীবন্ত সাংস্কৃতিক তীর্থস্থান। সুউচ্চ সাইপ্রাস গাছ, ঝরনাধারা ও গোলাপবাগানে ঘেরা এই স্থান প্রতি বছর হাজারো মানুষকে আকর্ষণ করে।
তাঁরা এখানে আসেন শ্রদ্ধা জানাতে, ধ্যান করতে বা 'ফাল-এ-হাফেজ' করতে— অর্থাৎ তাঁর 'দেওয়ান' থেকে যেকোনো একটি পৃষ্ঠা খুলে কবিতার মাধ্যমে জীবনের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে।
নওরোজ (পারস্য নববর্ষ) ও শাব-এ চেল্লা (শীতের দীর্ঘতম রাত্রি) উপলক্ষে হাফেজিয়েহ পরিণত হয় সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক মিলনমেলায়, যেখানে মানুষ কবিতা আবৃত্তি করে, গত বছরের প্রতিফলন ঘটায় ও নতুন বছরের প্রত্যাশায় মগ্ন হয়।
সাদি: নৈতিকতার কণ্ঠস্বর
১২১০ সালে শিরাজে জন্মগ্রহণ করেন আবু-মুহাম্মদ মুশাররফ আল-দিন মুসলেহ সাদি, যিনি মধ্যযুগীয় ইরানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও নৈতিক দার্শনিক।
জীবনের একটি বড় অংশ তিনি ইসলামিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে কাটান, এবং সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসেন শিরাজে।
তাঁর দুটি বিখ্যাত রচনা 'বুস্তান' (অর্থাৎ 'বাগিচা') ও 'গুলেস্তান' (অর্থাৎ 'গোলাপবাগান')।
১২৫৭ সালে রচিত 'বুস্তান' সম্পূর্ণ ছন্দোবদ্ধ একটি নৈতিক কাব্যগ্রন্থ, যেখানে ন্যায়, বিনয়, প্রেম ও তৃপ্তির শিক্ষা গল্পের আকারে উপস্থাপিত হয়েছে।
পরের বছর লেখা 'গুলেস্তান' গদ্য ও পদ্যের মিশ্রণে গঠিত, যাতে শাসননীতি, নৈতিকতা ও নীরবতার গুণাবলি নিয়ে আটটি অধ্যায় রয়েছে।
সাদির রচনাগুলো হাস্যরস, উপাখ্যান ও বাস্তব জীবনের উপদেশে ভরপুর, যা জটিল নৈতিক ভাবনাকেও সাধারণ মানুষের কাছে সহজ করে তোলে। তাঁর মানবতাবাদী দর্শন আজও অনুরণিত। তাঁর বিখ্যাত পঙ্ক্তি — “মানবজাতি এক দেহের অঙ্গ, সৃষ্টি হয়েছে এক আত্মা ও এক সত্তা থেকে।”
এই উক্তিটি জাতিসংঘের সদর দপ্তরে খোদাই করা রয়েছে, যা বিশ্বমানবতার প্রতি সাদির বিশ্বাসকে অমর করেছে।
শিরাজের মনোরম বাগানে অবস্থিত তাঁর সমাধি 'সাদিয়েহ' আজও দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে। প্রতি বছর ২১ এপ্রিল সাদির স্মরণে ইরানে পালিত হয় 'জাতীয় সাদি দিবস'।
বাগান, ফোয়ারা ও শান্ত পরিবেশ পাঠ, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাদির উত্তরাধিকারকে জীবন্ত রাখে।
জাহান মালেক খাতুন: শিরাজের নারী কবি
১৪শ শতকের শিরাজের রাজকন্যা ও কবি জাহান মালেক খাতুন মধ্যযুগীয় ইরানে বিরল এক দৃষ্টান্ত— তাঁর পূর্ণাঙ্গ কবিতা সংকলন আজও সংরক্ষিত আছে।
১৩২৫ সালের দিকে জন্ম নেওয়া এই রাজকন্যা ছিলেন তৎকালীন শিরাজের শাসক মাসুদ শাহের কন্যা। পিতার হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তাঁর জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছিল, যা তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত।
তাঁর সংকলনে রয়েছে গজল, রুবাই, প্রশস্তি ও শোকগাথা, এমনকি কন্যার মৃত্যুতে লেখা হৃদয়বিদারক কবিতাও।
ভালোবাসা, বেদনা ও প্রশংসার মতো বিষয় নিয়ে লেখা তাঁর কবিতা নারী অভিজ্ঞতার অন্তর্লোককে উন্মোচন করে, যা মধ্যযুগীয় ইরানে এক অসাধারণ কৃতিত্ব।
খাজু কেরমানি : দুই যুগের সেতুবন্ধন
১৪শ শতকের কবি খাজু কেরমানি জীবনের শেষ বছরগুলো কাটান শিরাজে।
ভালোবাসা, আকুলতা ও ঐশ্বরিক সৌন্দর্যের বিষয় নিয়ে লেখা তাঁর কবিতা গভীর আবেগ ও আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণ।
তিনি প্রায় ৪৪,০০০ পদ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে 'হোমায় ও হোমায়ুন', 'গুল ও নওরোজ', 'সানায়ে আল-কামাল', বাদায়ে আল-জামাল' এবং 'রওজাতুল-আনওয়ার' প্রভৃতি।
সাদি ও হাফেজের মধ্যবর্তী প্রজন্মে তিনি এক সেতুবন্ধন রচনা করেন— নৈতিক কাব্যের ধারাকে সংযুক্ত করেন মরমি গজলের রোমান্টিক স্রোতের সঙ্গে। তাঁর কবিতাশৈলী হাফেজের প্রারম্ভিক রচনায় প্রভাব ফেলেছিল বলে সাহিত্যিকরা মনে করেন।
ওবায়দ-ই জাকানি: শিরাজের ব্যঙ্গকবি
শিরাজের আরেক বিশিষ্ট কবি ওবায়দ-ই জাকানি সমাজ ও রাজনীতির অসঙ্গতিকে ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় প্রকাশ করার জন্য পরিচিত। যদিও তিনি হাফেজ বা সাদির মতো বিখ্যাত নন, তবু তাঁর রচনায় প্রকাশ পায় শিরাজের বুদ্ধিবৃত্তিক বৈচিত্র্য — যেখানে আধ্যাত্মিক, গীতিক ও ব্যঙ্গাত্মক সাহিত্য পাশাপাশি বিকশিত হয়েছে।
জাকানির কবিতায় সমাজের ভণ্ডামি, ক্ষমতাবানদের অন্যায় ও নৈতিক অবক্ষয়কে তীব্র বিদ্রূপে তুলে ধরা হয়েছে, যা প্রমাণ করে শিরাজ কেবল সৌন্দর্যের নয়, চিন্তা ও সমালোচনারও শহর ছিল।
জীবন্ত ঐতিহ্যের শহর শিরাজ
আজও শিরাজ তার সাহিত্য ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। হাফেজিয়েহ, সাদিয়েহসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থানে নিয়মিত কবিতা পাঠ, গবেষণা ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। নওরোজ ও 'শিরাজ দিবস'-এর মতো উপলক্ষে শহরজুড়ে কবিতার আবহ ছড়িয়ে পড়ে।
শিরাজের কবিতাপ্রেম শুধুমাত্র অতীতের গৌরব নয়- এটি আজও জীবন্ত। সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও দৈনন্দিন জীবনে কবিতা এখানকার প্রাণস্পন্দন।#
পার্সটুডে